দুসস ডেস্ক প্রতিবেদন ঃ রাজধানীর গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনের পাশেই ডিএনসিসি মার্কেটের দ্বিতীয় তলার ছাদে অবৈধভাবে দোকান বানিয়ে বরাদ্দ ও ভাড়া আদায় করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মালিকানাধীন গুলশান উত্তর কাঁচাবাজার ছিল দোতলা। প্রায় এক যুগ আগে এই বাজারে অবৈধভাবে তৃতীয় তলা করা হয়। এতে ১৪১টি দোকান বানিয়ে সেগুলো ভাড়া দিয়ে বছরে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এখানে রয়েছে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের কার্যালয়ও। নগর ভবনের নাকের ডগায় অবৈধভাবে তৃতীয় তলা করা হলেও কখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা উত্তর করপোরেশন। উচ্ছেদ অভিযান চালাতে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে পাঠানো নথিও অদৃশ্য ইশারায় গায়েব হয়ে গেছে।
রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে ডিএনসিসি নগর ভবনের বিপরীতে মাত্র ৫০ মিটার দূরে গুলশান উত্তর কাঁচাবাজার। করপোরেশনের কোনো কোনো কর্মকর্তার কক্ষ থেকে বাজার ভবনটি দেখা যায়। বাজারের নিচতলায় ২২৪টি এবং দোতলায় ৭৯টি বৈধ দোকান রয়েছে। কিন্তু তৃতীয় তলায় থাকা সব দোকানই অবৈধভাবে করা হয়েছে।
করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা ও বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, অবৈধ দোকানগুলোর বেশির ভাগের মালিক আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের।
ডিএনসিসি সূত্র থেকে জানাযায়, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেনের আমলে আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি চক্র জাল কাগজপত্র তৈরি করে তৃতীয় তলায় দোকান বরাদ্দ নিয়েছিল। তারা নিজেরাই দোকান তৈরি করে। তবে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে সাদেক হোসেন মেয়রের দায়িত্ব ছাড়ার আগে (২০১১ সালে) সেগুলো বাতিল করেন।
আওয়ামী লীগের একটি চক্র জাল কাগজ তৈরি করে তৃতীয় তলায় দোকান বরাদ্দ নেয়। নিজেরাই দোকান করে।
গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধ তৃতীয় তলার বাইরের অংশে সিমেন্টের আস্তর (প্লাস্টার) দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। সেগুলো ব্যবসায়ীরা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের কয়েকটি দোকান ও রেষ্টুরেন্টও রয়েছে।
তৃতীয় তলায় ৭৩ নম্বর দোকানের পাশে গুলশান থানা ছাত্রলীগের কার্যালয়। থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাহা মিঠুন কুমার এটি ব্যবহার করেন বলে গণমাধ্যমকে জানান কার্যালয়ে থাকা কাশেম নামের জনৈক ব্যক্তি। তবে সাহা মিঠুন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, তিনি ওই কার্যালয় ব্যবহার করেন না। এটি ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু ইউসুফ ব্যবহার করেন।
এ ছাড়া ১২১ নম্বর দোকানের পাশে ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় শ্রমিক লীগের অস্থায়ী কার্যালয়। গুলশান থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক এমারাত হোসেন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল বাশার কক্ষটি ব্যবহার করেন বলে জানাযায়।
দুজনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে গণমাধ্যম কর্মীরা তাঁদের দেখা পাননি। কার্যালয়ও বন্ধ পাওয়া যায়। আশপাশের দোকানিদের কাছ থেকেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নিচতলায় ২২৪টি ও দ্বিতীয় তলায় ৭৯টি দোকান থেকে মাসে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৬ টাকা হিসাবে বছরে ৩৩ লাখ ৩ হাজার ৭৯২ টাকা আদায় করা হয়।
উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, সম্পত্তি বিভাগ থেকে বরাদ্দ দেওয়া দোকান থেকে ভাড়া তোলা হয়। তৃতীয় তলায় করপোরেশন কাউকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তাই ভাড়াও নেওয়া হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিচতলার এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, মূলত আবদুল মালেক ও আবদুস সালাম নামের দুই ব্যক্তি ২০১০ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ নেওয়ার কাজটি করেন। মালেক বর্তমানে গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সালাম ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগের নেতারাই তৃতীয় তলার দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন।
জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে আবদুল মালেক গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, মেয়র সাদেক হোসেনের সময় দোকানগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দোকান করার পর সিটি করপোরেশন ২ মাস প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা করে ভাড়াও নিয়েছিল। এর ব্যাংক রসিদ ব্যবসায়ীদের কাছে রয়েছে। কিন্তু এখন সিটি করপোরেশন ভাড়া নিচ্ছে না।
অবৈধ মার্কেট পরিচালনায় তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করে আবদুস সালাম বলেন, ‘নিচতলায় আমার কুমিল্লা ক্রোকারিজ নামের একটি দোকান রয়েছে। তিনতলায় একটি দোকান কিনে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছি।’ তবে দোকানটি কবে, কার কাছ থেকে কিনেছেন, সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা।
একজন গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় গোপন করে তৃতীয় তলায় দোকান ভাড়া নিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন। ব্যবসায়ীরা তিনতলায় সিরাজুল ইসলাম নামের এক চা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সিরাজুলের কাছে গেলে তিনি দোকান খালি নেই জানিয়ে মুঠোফোন নম্বর রেখে যেতে বলেন। ওই দিন বিকেলেই তিনি ফোনে জানান, দোকান পাওয়া গেছে। প্রতি মাসে ভাড়া সাত হাজার টাকা। তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম দিতে হবে। তবে দোকান মালিকের নাম তিনি বলতে চাননি।
সিরাজুল ও ব্যবসায়ীদের দেওয়া ভাড়ার তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় তলায় একেকটি দোকানের ভাড়া সাত থেকে আট হাজার টাকা। গড়ে ৭ হাজার টাকা হিসাবে ১৪১টি দোকান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া আসে ৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, এক বছরে যা প্রায় ১ কোটি সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। অথচ সিটি করপোরেশন দুটি তলা থেকে পায় মাত্র ৩৩ লাখ টাকা।
সম্পত্তি বিভাগ থেকে জানানো হয়, সর্বশেষ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই চিঠি এখনো সম্পত্তি বিভাগে ফিরে আসেনি। নথির সর্বশেষ অবস্থা কী তাও কেউ জানেন না।
কাঁচাবাজারের একটি দোকানে ব্যবসায়ী পরিচালনা কমিটির অফিস রয়েছে। কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাহিবুর রহমান তৃতীয় তলার বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন অবৈধ অংশটির সুবিধা নিচ্ছেন। করপোরেশনের অনেকের পকেটেও ভাগ যাচ্ছে। এসব কারণে অবৈধ অংশটি উচ্ছেদ হচ্ছে না।
করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহে আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা মুঠোফোনে গণমাধ্যমে বলেন, পরিত্যক্ত ওই কাঁচাবাজার ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেকোনো সময় ভেঙে ফেলা হবে। বিগত বছরে সেখানে কী ঘটেছে, সেসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ওই জায়গায় আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে বলে তিনি জানান।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply