আদালত কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হওয়া প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত ইসলামী আবারো আলোচনায়। জুলাই বিপ্লবে ইসলামি ছাত্রশিবিরের স্বীকৃত অসাধারণ ভুমিকা ও বিপ্লব পরবর্তী জামায়াতের অস্বাভাবিক উত্থান সর্বসাধারণের মনোজগতে জামায়াত-শিবির পজিটিভ ঝড় তুলেছে এবং আরেকটি পক্ষ ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা বাদ দিয়ে অথবা আমি যদি এভাবে বলি জনসম্পৃক্ত কাজ বাদ দিয়ে জামায়াত বিরোধিতায় বেশী মনযোগী হওয়ায় এবং জামায়াতের দলীয়ভাবে ইসলামি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও আলেম উলামার সাথে নিবিড় যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম নিয়ে জনগণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে আলোচিত-সমালোচিত এ দলটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
গত ১৫ বৎসর (জুলাই বিপ্লবের আগ পর্যন্ত) সরকারের প্রচন্ড নির্যাতন ও প্রকাশ্যে সভা সমাবেশ করতে না পারলেও কঠোর দলীয় আনুগত্য ও সু-শৃংখল কর্মী বাহিনীর কারণে দলটি এগিয়েছে বলে জামায়াত পন্থিদের ধারণা। ১৯৪১ সালে লাহোরে ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে জামায়াত ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খ্যাতনামা ইসলামি চিন্তাবিদ সৈয়দ আবুল আ’লা মওদুদী।
মওলানা মওদুদীর রচিত বিশাল ইসলামি সাহিত্যের ভান্ডার রয়েছে। আলোচনা সমালোচনা থাকলেও তাঁর সাহিত্য ও তাফসীর গ্রন্থ তাফহীমুল কোরআন আধুনিক শিক্ষিত মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ঢাকায় সংগঠনটির দাওয়াতি কার্যক্রমে বেশি ভূমিকা রাখেন লেখক, গবেষক খুররম জাহ মুরাদ, এ নামটি এখনকার নেতৃত্ব মনে রাখছেন কিনা জানিনা। বাংলাদেশ অঞ্চলে জামায়াতের বিস্তৃতিতে যাদের ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়, তাদের মধ্যে প্রধানতম মাওলানা আব্দুর রহিম। বিশ্বের সর্বকালের কয়েজন ইসলামি চিন্তাবিদের একজন মাওলানা আবদুর রহিম, তিনি পরবর্তীতে জামায়াতে থাকতে পারেননি। এছাড়াও আরো যাদের ভুমিকা ছিল তাদের মধ্যে আব্দুল খালেক, অধ্যাপক গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, শামসুর রহমান মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ অন্যতম। এঁরা কেউই বেঁচে নেই। জামায়াতের ২য় প্রজন্মের নেতারাও কেউ কেউ যুদ্ধপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে এবং অন্যরা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানে সংগঠনটি ৩য় ও চতুর্থ প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। বয়স ও অভিজ্ঞতা কম হলেও মাঠের কর্মীরা তাদের দল পরিচালনা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতি সন্তষ্ট বলে জানা যায়।
জামায়াতের অগ্রগতির পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের। মেধা শূন্য সন্ত্রাস নির্ভর ছাত্র নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যানের স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাত্র সংগঠনটি এক সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজ গুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে। শিবির ও ইসলামি ছাত্রিসংস্থার কর্মী সমর্থক ছিলেন (বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে) এরকমের সংখ্যা ১ কোটির বেশী বলে জানা যায়। গত ১৫ বছর থেকে তাদেরকে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে না দেয়ার কারণে শিবিরের বর্তমান অবস্থা বুঝা মুশকিল। তবে বর্তমানে জামায়াতের শীর্ষ ও মহানগর পর্যায়ের অধিকাংশ নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিবিরের সাবেক নেতারা। শিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন ২ জন সভাপতি মীর কাশেম আলী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। বাকী সাবেক সভাপতিদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও ২ জন সাবেক সভাপতি বিদেশে স্থায়ীভাবে আলিশান জীবন যাপন করছেন। একজন সাবেক সভাপতি নিস্ক্রিয় আরেকজন অসুস্হ। একজন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অন্য একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আরেকজন অ-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি। শিবিরের সাবেক সভাপতিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী থেকে হোমিও ডাক্তার পর্যন্ত আছেন। এদের মধ্যে ৫ জন জামায়াত থেকে দুরে থাকায় প্রশ্ন উঠতে পারে সভাপতি থাকার সময় তারা কি শিক্ষা দিয়েছেন ও কি দীক্ষা নিয়েছেন।
শিবিরের গঠনতন্ত্রের আলোকে সাবেক থেকে দুজন কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদ সদস্য থাকেন। মুলত জামায়াতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুজন শিবিরের কার্যকরি পরিষদ সদস্য হয়ে থাকেন। তাদের অভিমতের প্রতিফলনে সেক্রেটারি জেনারেল মনোনয়ন দেয়া হয় যিনি পরবর্তীতে সদস্যদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন। কেউ কেউ বলে থাকেন সম্ভবত ৯৬/৯৭ সালের দিকে ২ জন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির পদ সৃষ্টি হলে জামায়াতের চিন্তার বাইরে একজন সভাপতি হয়ে যাওয়ায় সহ -সভাপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। সব কিছু মিলিয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া দলটি এখন পর্যন্ত তাদের কর্মী সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সক্রিয় রাখতে পেরেছে যাহা বাংলাদেশের বাস্তবতায় অন্যকোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ।
এ এফ এম সোলায়মান চৌধুরী ও মজিবুর রহমান মন্জুর নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক নেতা কর্মীর চলে যাওয়ায় জামায়াত কতটা হোঁচট খেয়েছে জানিনা তবে পূর্বেও এভাবে আবিস্কার বহিস্কার পদত্যাগ কম হয়নি। মাওলানা আবদুর রহিম ছাড়াও প্রখ্যত আইনজীবী ব্যারিষ্টার কোরবান আলী থেকে ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাক সহ কোন কোন নেতার চলে যাওয়া বা বহিষ্কার বা নিস্ক্রিয় হওয়ায় জাময়াতের চলার পথে তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে ঝাঁকুনি খেয়েছ কয়েকবার শিবির সংক্রান্ত ঝামেলায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ ১৯৮১ সালে যুব শিবির বিতর্ক, আওয়ামী লীগের ২০০৯ সাল পরবর্তী শাসন আমলে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে নিয়ে বিতর্ক এবং মাঝখানে সাবেক থেকে কার্যকরি পরিষদ সদস্যের রুকনিয়াত বাতিল বিতর্ক।
তবে নির্মোহ আলোচনায় বলতে হবে সম্পুর্ন প্রতিকুলতার মধ্যেও বিশাল সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী নিয়ে টিকে থাকা রাজনৈতিক দলের নাম জামায়াতে ইসলামী।
অনেকের সাথে কথা বলে ধারণা হয়েছে বর্তমান অস্বাভাবিক ও অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ও তাদের মিত্রদের অরাজনৈতিক বালখেল্য বক্তব্য ও মন্তব্য তাদের উদ্দেশ্যহীন রাজনৈতিক দলে রুপান্তর ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে জনসাধারণের আগ্রহী করে তুলছে।
(কৈফিয়ত : আমার এ প্রতিবেদনে নিজস্ব আদর্শ, আগ্রহ ও ভালোলাগা-ভালোবাসা কাজ করেনি। যা দেখেছি এবং শুনেছি ও যাচাই-বাছাই করে উপলব্ধির আলোকে নির্মোহ দৃষ্টিতে আলোচনা করেছি। এতে করে বন্ধু বান্ধবরা ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে সামষ্টিক পর্যালোচনা হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং জোরালো ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন।)
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply