নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মোবাইল ফোনের বেস ট্রান্সিভার স্টেশন বা বিটিএস টাওয়ার স্থাপনে অনেক দেশ নিরাপদ নীতিমালা অনুসরণ করলেও এ নিয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কোনো রকম স্বাস্থ্য সমীক্ষা ছাড়াই মোবাইল ফোন অপারেটররা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, বাড়ি, স্কুল এমনকি হাসপাতালের ছাদেও স্থাপন করেছে বিটিএস টাওয়ার। গবেষকরা বলছেন, এসব টাওয়ারের রেডিয়েশন (বিকিরণ) শুধু মানবদেহের জন্যই নয়, পশু-পাখি ও কীটপতঙ্গের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। একই এলাকায় ৫ অপারেটর আলাদা আলাদা টাওয়ার স্থাপন করায় এ ঝুঁকি আরো বেড়েছে। তাই দ্রুত এ সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এদিকে, মোবাইল ফোন টাওয়ারের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে উদ্ব্যেগ রয়েছে খোদ উচ্চ আদালতেরও। ২০১২ সালের একটি রিট আবেদনের চুড়ান্ত শুনানি করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে ১১ দফা নির্দেশনা দেন আদালত। এতে মোবাইল টাওয়ারের ক্ষতিকর রেডিয়েশন (বিকিরণ) বিষয়ে সমীক্ষা করে চার মাসের মধ্যে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার থেকে নিঃসৃত রেডিয়েশনের মাত্রা উচ্চপর্যায়ের, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদন মানতে আপত্তি জানায় মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। তারা বিশ্বের উন্নত দেশের উদাহরণ দেখিয়ে দাবি করে, আধুনিক বিশ্বেও এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে টাওয়ারের সিগন্যাল আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। উচ্চ আদালতেও তারা এমন দাবির পক্ষেই অবস্থান নেয়। এ বিষয়ে একটি গবেষণা রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ডঃ গোলাম মোহাম্মদ ভুঞার। তিনি জানান, প্রত্যেক টাওয়ার থেকেই কম বেশি রেডিয়েশন নির্গত হয়। আর রেডিয়েশন সবার জন্যই ক্ষতিকর। রেডিয়েশনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়ে শিশুরা। মানুষের শরীরের সেলগুলোর যোগাযোগ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে এক্সটারনাল রেডিয়েশন। আর এর পরিণতিতে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও তৈরি হয়। বাচ্চাদের শরীরে ফ্লুইড বেশি থাকার কারণে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এ রেডিয়েশন ভুমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জেনেটিক পরিবর্তন, অবসন্নতা, লিউকেমিয়াসহ আরো কিছু রোগের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে রেডিয়েশনের কারণে।
আন্তর্জাতিক নন আয়নাইজিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, মানবদেহের জন্য রেডিয়েশনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কান ও মস্তিষ্কের টিউমার সৃষ্টি হওয়া। এ ছাড়া রেডিয়েশনের কারণে মাথাব্যথা, হৃদরোগ, ঘুম ঘুম ভাব, নিদ্রাহীনতা কাজের ব্যাঘাত ঘটাসহ অনেক সমস্যা হতে পারে। মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন চড়ুই, মৌমাছি, শালিকসহ বিভিন্ন প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকারক বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় সংস্থাটি। গবেষকরা জানান, মোবাইল টাওয়ার থেকে মূলত একপ্রকার ত্বরিৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ সৃষ্টি হয়। এই বিকিরণ গন্ধ, বর্ণ ও শব্দহীন এবং অদৃশ্য। বিশ্বের অনেক দেশে টাওয়ার স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ টাওয়ার লোকালয়, বাড়ি, হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাত্রা মনিটরও তেমন একটা করা হচ্ছে না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে নতুন কোনো টাওয়ার স্থাপন না করার নিয়ম চালু রয়েছে। আর টাওয়ারগুলোর উচ্চতাও নির্ধারণ করা হয়েছে কমপক্ষে ১৯৯ ফুট উঁচু।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৫টি মোবাইল ফোন অপারেটর তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর তাদের স্থাপন করা বিটিএসের সংখ্যা সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার। গত বছরের নভেম্বরে ৪টি কোম্পানিকে টাওয়ার শেয়ারিং ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়। এটি কার্যকর হলে একই কাভারেজ এলাকায় একটি টাওয়ার দিয়েই ৫ অপারেটর তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে। ফলে কমে আসার কথা টাওয়ারের সংখ্যা। নীতিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্স পাওয়ার এক বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের সব বিভাগীয় শহরে, দ্বিতীয় বছরে জেলা শহরে, তৃতীয় বছরে ৩০ শতাংশ উপজেলা, চতুর্থ বছরে ৬০ শতাংশ উপজেলা এবং পঞ্চম বছরে দেশের সব উপজেলায় টাওয়ার সেবা দেয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালুই করা যায়নি বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, মানুষের জন্য ঝুঁকি কমাতে যথাসম্ভব নিরাপদ জায়গায় টাওয়ারগুলোকে নতুনভাবে স্থাপন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠানকে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে যত্রতত্র স্থাপন করা টাওয়ারগুলো সরিয়ে ফেলা হবে। দূরত্ব, জনবসতি সবকিছু বিবেচনায় এনেই এ কাজটি করা হবে, যেন তা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ না হয়। উচ্চ আদালতে এ নিয়ে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ বলেন, আন্তর্জাতিক নন আয়জনিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন বা আইসিএআইআরপির নির্দেশনা মতো রেডিয়েশন দশ মেগাহার্টজে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, জনসংখ্যা ঘনত্ব ও পরিবেশ বিবেচনায় এটি বাংলাদেশে হওয়া উচিত এর দশ ভাগের এক ভাগ।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply