মুখ ভর্তি দাড়ি। পরণে থাকে সাদা সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবী। বলেন নীতি কথা। তাই তাকে এলাকাবাসী ডাকেন ‘দরবেশ’ ভাই বলে। তবে তিনি নবাবগঞ্জের দরবেশ সালমান এফ রহমান নন। নন পীরের মাজারের দরবেশ।
তিনি রূপগঞ্জের পূর্বাচলের দরবেশ। তার হাতে শোভা পায় লাখ টাকার ঘড়ি। চড়েন কোটি টাকা দামের গাড়িতে। দুইযুগ আগে ছিলেন আন্তজেলা ডাকাত দলের সর্দার। তার ভয়ে কাঁপতো পুরো রূপগঞ্জসহ আশপাশের এলাকা। আওয়ামী লীগের যোগ দিয়ে ধনকুবের বনে যান।
পূর্বাচল উপশহরে একডনের অধিক তার প্লট রয়েছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট, রাজশাহীতে আমের বাগানসহ অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। সর্বশেষ ৫ বছর তিনি রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি আর কেউ ননয়। তিনি হলে মো. ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া। গোটা পূর্বাচল উপশহরই তার কাছে জিম্মি। পূর্বাচলে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ বিদেশী অস্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে তার নাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া উপজেলার শিমুলিয়া এলাকার মৃত গোলজার হোসেন ভুঁইয়ার ছেলে। বিগত ১৯৯৮-২০০০ সালের দিকে ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া আন্তজেলা ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন। তার নেতৃত্বে রূপগঞ্জসহ সারাদেশে ডাকাতি সংঘটিত হতো। ঐসময় তার নামে বেশ কয়েকটি ডাকাতির মামলাও হয়েছিল। গত ২০০০ সালে পূর্বাচল উপশহরের কাজ শুরু হলে বোল পাল্টে ছালাহউদ্দিন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
ছালাহউদ্দিনের ছোট ভাই রাকিবসহ আরো যুবক নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। পরে ছালাহউদ্দিন রূপগঞ্জ ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে পুরো পূর্বাচল উপশহরকে জিম্মি করে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যান। পরেরবার সাবেক এমপি গাজীর হাত ধরে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে পাথর, কয়লা, মাদক ব্যবসাসহ কিশোরগ্যাং নিয়ন্ত্রণ, হত্যা, পূর্বাচলে প্লটের দখল বাণিজ্য, পূর্বাচলের আদিবাসীদের জিম্মি করে নামমাত্র দাম দিয়ে প্লট কিনে নেয়াসহ নানা অপকর্ম করতে থাকে।
২০০৫ সালের ২৬ জুন বেলায়েত হোসেন হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি ছিলেন ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়ার বাবা গোলজার হোসেন ভুঁইয়া। তার বাবার নেতৃত্বেই সুলপিনা গ্রামের আবুল হোসেন মাষ্টারের ছেলে ঠিকাদার বেলায়েত হোসেনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৮ সালে উপজেলার কাঞ্চন ব্রিজের পশ্চিম পাশে যুবলীগ কর্মী সুমন হত্যা
মামলার আসামি হন ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া। ২০১৭ সালে ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়ার পুরাতন বাড়ি পূর্বাচলের ৫নং সেক্টরের সুলপিনা একালা থেকে এসএমজি রাইফেল, রকেট লঞ্চারসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এসকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া ও তার ছোট ভাই রাকি ভুঁইয়াকে এজারভুক্ত আসামী করা হয়। পূর্বাচলের ৫নং লেকটি ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া ও তার ছোট ভাই রাকিব মাছ চাষ করতো। পরে ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া এমপি গাজীর সহযোগিতায় ২ কোটি টাকার বিনিময়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তার নাম এজাহার থেকে বাদ দেয়া হয়।
পূর্বাচল উপশহরের ১নং, ২নং, ৩নং ও ৬নং ওয়ার্ডে অবৈধ আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে জোরপূর্বক বালু ভরাট, ভুয়া দলিলে জমি রেজিষ্ট্রিসহ নানা অপকর্ম করে আসছে। রাজউকের ৪নং সেক্টরের শীতলক্ষ্যা নদী সংলগ্ন জমি, উত্তর ব্রাহ্মণখালী ও শিমুলিয়া গ্রামের মানুষের জমি জোরপূর্বক দখল করে কয়লা, বালু ও পাথরের ব্যবসার পাশাপাশি গড়ে তোলেন মাদকের ডিপো। এসময় ব্যবসা দেখাশুনা করেন ছালাহউদ্দিনের আরেক ভাই হামিদ ভুঁইয়া। এ ব্যবসার মাধ্যমে পরিবহন সেক্টরেও নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন ছালাহউদ্দিন।
তার ২০টি ড্রাম ট্রাক, ২টি ক্রেনসহ কয়েকটি ট্রাক রয়েছে। এসকল অপকর্মের মাধ্যমে ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। পূর্বাচল উপশহরের ১নং ও ৫নং সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে তার রয়েছে একডজনের বেশি প্লট। যার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
দাউদপুর ইউনিয়নের হাটাবো এলাকায় সালফিয়ার মাদ্রাসার পাশে বিলাশবহুল ভবন রয়েছে। যার মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি। শিমুলিয়া এলাকার চারতলা বিশিষ্ট বিলাশবহুল বাড়ি রয়েছে। পূর্বাচলের পাশে বাগবেড় এলাকায় রয়েছে কয়েক বিঘা জমি। যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। রূপগঞ্জ গ্রামের আব্দুল হক ভুঁইয়া স্কুল এন্ড কলেজের দক্ষিণপাশে রয়েছে ৪ কোটি টাকা মূল্যের জমি। মধুখালী এলাকায় ৩০০ শতাংশ জমি জোরপূর্বক কৃষকদের কাছ থেকে জবরদখল করে নিয়েছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় ফ্ল্যাটসহ রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় অর্ধশত বিঘা জমি রয়েছে ছালাহউদ্দিন ও তার পরিবারের নামে।
ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়ার সৌখিনতার কারণে রাজশাহীতে জমি কিনে সেখানে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কলেজছাত্র জিসান হত্যা মামলার আসামিও ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া।
ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া তার ভাই হামিদ ও রাকিবকে দিয়ে এলাকায় গড়ে তোলেন ১০০ জনের কিশোরগ্যাং বাহিনী। কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে মাদক বিক্রি, জমিজমা জোরপূর্বক দখলসহ নানা অপকর্মে ব্যহার করা হতো। এছাড়া কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করতো। গত কয়েক মাস আগে ছালাহউদ্দিন তার বাহিনীর সদস্য পিষ্টন রাসেল ও সাগরকে দিয়ে নিরীহ মানুষদের কুপিয়ে জখম করেছে
ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া চেয়ারম্যান থাকাকালীন ভুক্তভোগীরা মামলা পর্যন্ত করতে পারেনি। ছালাহউদ্দিনের কথা ছাড়া রূপগঞ্জ থানায় মামলা হতো না। ঢাকা আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মেলাতেও ছিল ছালাহউদ্দিনের একক আধিপত্য।
পূর্বাচলে তিনবার ঢাকা আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এ তিনবারই চেয়ারম্যান হওয়ার প্রভাব খাটিয়ে নামমাত্র মূল্য দিয়ে আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ নামে বাণিজ্য মেলার ইজারা নেন ছালাহউদ্দিন।
মেট্রোরেলের জন্য জমি অধিগ্রহণের নিরীহ কৃষকদের সাথে নয়ছয় করতে ছালাহউদ্দিন। মেট্ট্রোরেলের জন্য রূপগঞ্জ উইনয়নের জমি অধিগ্রহণ চলছিল। জমি অধিগ্রহণের বিলের টাকা ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়াকে চড়া পার্সেন্ট না দিয়ে উত্তোলন না করলে মানুষের বিলের মধ্যে নামে বেনামে অভিযোগ করাতো।
পূর্বাচল লেক দখল করে মাছ চাষ:
পূর্বাচলের সিংহভাগ লেকই ছালাউদ্দিনের দখলে। লেক দখল করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেন ছালাহউদ্দিন। এলাচাড়া তার দুই ভাইকে দিয়ে লেকের পাশে অবৈধভাবে গড়ে তোলে রেস্টুরেন্ট ও মেলা। মেলার দোকান বরাদ্দ নিতে ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েখজন ভুক্তভোগী বলেন, ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়ার কাছে পুরো পূর্বাচল উপশহর জিম্মি হয়ে পড়েছে। ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়া এক সময় ডাকাতদলের সর্দার থাকলেও রূপগঞ্জ ইউনিয়নসহ পূর্বাচলে প্লটসহ অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। বিভিন্ন আবাসন কোম্পানীর হয়ে ছালাহউদ্দিন সাধারণ মানুষের জমিতে জোরপূর্বক বালু ভরাট করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ছালাহউদ্দিন ভুঁইয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহৃত নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply