বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে (চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনা সাপ) এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনাঃ বিষধর সাপের একটি প্রজাতি। চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনাঃ(বৈজ্ঞানিক নাম: Daboia russelii) ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম একটি বিষধর সাপ এবং উপমহাদেশের প্রধান চারটি বিষধর সাপের একটি।
চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনাঃ ১৭৯৭ সালে জর্জ শ এবং ফ্রেডেরিক পলিডোর নোডার কর্তৃক বর্ণিত হয়। প্যাট্রিক রাসেল ১৭৯৬ সালে তার অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সারপেন্টস, কালেক্টেড অন দা কোস্ট অফ করোমান্ডেল বইয়ে চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনা সম্পর্কে লিখেছিলেন ও তার নাম অনুসারে এটি রাসেল ভাইপার নামেও পরিচিত।
চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনার বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসঃ
(জগৎ/রাজ্য: অ্যানিম্যালিয়া(Animalia)
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণি: রেপটিলিয়া (Reptilia)
বর্গ: Squamata
উপবর্গ: সারপেন্টস (Serpentes)
পরিবার: ভাইপারিডি (Viperidae)
গণ: Daboia
(শ এবং নোড়ার, ১৭৯৭)
প্রজাতি: D. russelii
দ্বিপদী নাম
Daboia russelii
(শ এবং নোড়ার, ১৭৯৭)
প্রজাতিটির বিস্তৃতি
প্রতিশব্দ
Coluber russelii শ ও নোডার, ১৭৯৭
Coluber daboie
Latreille In Sonnini & Latreille, 1801
Coluber trinoculus
Schneider In Bechstein, 1802
Vipera daboya Daudin, 1803
Vipera elegans Daudin, 1803
Coluber triseriatus Hermann, 1804
Vipera russelii — Gray, 1831
Daboia elegans — Gray, 1842
Daboia russelii — Gray, 1842
Daboia pulchella Gray, 1842
Echidna russellii Steindachner, 1869
চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনা সাপ।
বর্ণনা
চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনার দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক মিটার; দেহের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটার পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। থুতনি ভোঁতা, গোলাকার এবং উত্থিত। নাসারন্ধ্র বড়ো, যার প্রতিটি একটি বড়ো ও একক অনুনাসিক স্কেলের মাঝখানে অবস্থিত। অনুনাসিক স্কেলের নীচের প্রান্তটি নাসোরোস্ট্রাল স্কেলে স্পর্শ করে। সুপ্রানসাল স্কেল একটি শক্তিশালী অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি ধারণ করে এবং নাসালকে সামনের দিকে নাসোরোস্ট্রাল স্কেল থেকে আলাদা করে। রোস্ট্রাল স্কেল যেমন বিস্তৃত তেমনি এটি উচ্চ। চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনার শরীর লেজসহ সর্বোচ্চ ১৬৬ সেমি (৬৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে গড় প্রায় ১২০ সেমি (৪৭ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে। দ্বীপে আকৃতি সাধারণত কিছুটা ছোট হয়ে থাকে। এটি বেশিরভাগ ভাইপারের চেয়ে সরু। নিম্নলিখিত মাত্রাগুলি ১৯৩৭ সালে প্রমাণ আকারের প্রাপ্তবয়স্ক চন্দ্রবোড়ার নমুনা হিসাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল:
মোট দৈর্ঘ্য ১.২৪ মি (৪ ফুট ১ ইঞ্চি)
লেজের দৈর্ঘ্য ৪৩০ মিমি (১৭ ইঞ্চি)
ঘের ১৫০ মিমি (৬ ইঞ্চি)
মাথার প্রস্থ ৫১ মিমি (২ ইঞ্চি)
মাথার দৈর্ঘ্য ৫১ মিমি (২ ইঞ্চি)
বাসস্থান ও বিস্তৃতিঃ
চন্দ্রবোড়া সাপ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে দেখা যায়। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায়, বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও বাঁকুড়া জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ দেখা যেত। যে কারণে এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল। বর্তমানে পদ্মা অববাহিকা ধরে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া বা চন্দ্র ঘোনা বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজশাহী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, হাতিয়া, ভোলাতে চন্দ্রবোড়ার উপস্থিতি পাওয়া দেখা গেছে।
চন্দ্রবোড়া ভারত ও বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে।
নদীয়া জেলাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে এছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীনের দক্ষিণাংশ, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়।
স্বভাবঃ
চন্দ্রবোড়া সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের ক্ষেতে, বিশেষত নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। স্থলভাগের সাপ হলেও এটিকে জলে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। ফলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে। এরা নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকি ও ব্যাঙ ভক্ষণ করে। বসতবাড়ির আশেপাশে চন্দ্রবোড়ার খাবারের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে চন্দ্রবোড়া অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে।
চন্দ্রবোড়া সাধারণত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আক্রমণ করে না, কিন্তু একটি সীমার পর তাকে বিরক্ত করলে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়। তবে “মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায়” এ কথা গুজব মাত্র। এরা মূলত ambush predator, তাই এক জায়গায় চুপ করে পড়ে থাকে। মানুষ বা বড় কোন প্রাণী সামনে এলে S আকৃতির কুণ্ডলী পাকিয়ে খুব জোরে জোরে হিস্ হিস্ শব্দ করে। তারপরও তাকে বিরক্ত করা হলে তবেই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছোবল মারতে পারে। ছোবল দেওয়ার সময় শরীরের সামনের দিকটা ছুঁড়ে দেয় বলে ঐ “তেড়ে এসে কামড়ায়” জাতীয় ভুল ধারণার জন্ম।
এদের বিষদাঁতের আকার অন্যান্য ভাইপার জাতীয় সাপের সাথে তুলনীয় এবং কিছু র্যাটেলস্নেকের প্রজাতির থেকে ছোটও। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। চন্দ্রবোড়া দিনে ও রাতে উভয় সময়ে কামড়ায়। অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু চন্দ্রবোড়া অনেক সময় দংশন করে ধরে রাখতে পারে।
অন্যান্য সাপের মতোই চন্দ্রবোড়াও সাধারণত মানুষকে এড়িয়েই চলে, কিন্তু লোকালয়ের কাছাকাছি ক্ষেতে কিংবা ঘাসজমিতে, কিংবা অনেক সময় ইঁদুর শিকার করতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ফলে মানুষের সঙ্গে এর সংঘাত প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কেবল এ সাপটির কামড়েই প্রাণ হারান। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ‘কিলিংমেশিন’ হিসেবে বদনাম রয়েছে সাপটির। তবে এই সাপ সম্পর্কে নানা অতিরঞ্জিত গুজবও ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রজননঃ
সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। ফলে সাপের বাচ্চাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে থেকে পরের তিন মাস প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো চন্দ্রবোড়া সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ড আছে।
বিষঃ
চন্দ্রাবোড়ার বিষদাঁত solenoglyphous, অর্থাৎ মুখ বন্ধ করলে দাঁত ভাঁজ হয়ে মুখের সঙ্গে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। একটি চন্দ্রবোড়া সাপ এক ছোবলে বেশ খানিকটা বিষ ঢালতে পারে। পূর্ণবয়স্ক সাপের ক্ষেত্রে বিষের পরিমাণ ১৩০-২৫০ মিলিগ্রাম, ১৫০-২৫০ মিলিগ্রাম এবং ২১-২৬৮ মিলিগ্রাম মাপা হয়েছে। ৭৯ সেমি (৩১ ইঞ্চি) গড় দৈর্ঘ্যের শিশু চন্দ্রবোড়ার বিষের পরিমাণ ৮ থেকে ৭৯ মিলিগ্রাম (গড় ৪৫ মিলিগ্রাম) অবধি দেখা গেছে।
লক্ষণ
চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে তাৎক্ষণিক ক্ষতস্থানে ব্যথা শুরু হয় ও কিছুক্ষণের মধ্যে ক্ষতস্থান ফুলে যায়। রক্তক্ষরণ এর একটি সাধারণ লক্ষণ। এছাড়া রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার কমে যায়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বমি হয় ও মুখমণ্ডল ফুলে যায়। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে ২৫-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি অকার্যকর হয়ে যায়। চন্দ্রবোড়ার বিষ হেমোটক্সিক, অর্থাৎ এর প্রভাবে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয় ও বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- ফুসফুস, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুত চিকিৎসা নিলে ও সত্বর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে বিষক্রিয়া সম্পর্কিত নানা শারীরিক জটিলতার হার বহুলাংশে কমানো যায়।
অ্যান্টিভেনম চিকিৎসা,
ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে বিষধর সাপের বিষ প্রতিরোধের জন্য যে polyvalent antivenom (ভারতের Haffkine Institute এ তৈরি) প্রয়োগ করা হয়, তার দ্বারা চন্দ্রবোড়ার বিষেরও প্রতিরোধ সম্ভব।
২০১৬ সালে কোস্টারিকার Clodomiro Picado Institute একটি নতুন অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছে এবং শ্রীলঙ্কায় তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রয়োগ
চন্দ্রবোড়ার বিষ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, একারণে হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত পরীক্ষায় এর ব্যবহার রয়েছে। রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভধারণ বিষয়ক জটিলতা যেমন- গর্ভপাতকারী এক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় (ডাইলিউট রাসেল’স ভাইপার ভেনম টাইম) লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্টের উপস্থিতি নির্ণয়ে চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়।
অবস্থা
২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এটিকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং ও বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এছাড়াও শঙ্খিনী, গাবুন ভাইপার, সরীসৃপ (সাপ), পাতি কাল কেউটে,
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply