ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়: সম্প্রতি কলকাতার বিখ্যাত আরজি কর হাসপাতাল কুখ্যাত সংবাদের শিরোনামে। এক সম্ভাবনাপূর্ন মেয়ে চিকিৎসককে নির্মম অত্যাচার করে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে উত্তাল সারা পশ্চিমবঙ্গ, সারা ভারত সহ বিশ্বের ৪২ টি শহর।জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার বিক্ষোভ, মিছিল, স্লোগান ,অবস্থানে কার্যত এখনো সারা রাজ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই নিকৃষ্ট কাণ্ডে জড়িত বলে তাদের বাঁচানোর জন্য প্রশাসন সর্ব শক্তি দিয়ে দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ডাক্তারদের কাজে যোগদানের জন্য ১০ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সময় নির্ধারিত করার পরও জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে যোগদান না করে প্রকৃত সকল অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে অটল রয়েছেন। শুধু ডাক্তাররাই নন,আইনজীবী, শিক্ষক, সমাজসেবী, সাধারণ মানুষ, রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক ,পরিবারের মহিলারাও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবি জানিয়ে চলছেন। শীর্ষ আদালত বিচারের পরিবর্তে ডাক্তারদের কাছে যোগদানের চরমসীমা নির্ধারণ করায় ক্ষোভ আরো বেড়ে গেছে। সারা কলকাতার রাস্তা অবরোধ করে একমাস ধরে চলছে এই বেনজীর প্রতিবাদ। অথচ এই আরজি কর অতীতে ছিল এক স্বর্ণখচিত হাসপাতাল। অথচ আজ কলঙ্কিত কতিপয় সমাজবিরোধী,বিত্তবান, ব্যক্তির জন্য এটি নরককুন্ডে পরিণত হয়েছে।তবে যেভাবে সারা রাজ্য,দেশ,বিদেশে বিচারের দাবিতে সোচ্চার আন্দোলন শুরু হয়েছে,তাতে ন্যায় বিচারের আশা করছেন অনেকে। ইতিমধ্যেই হাসপাতাল গুলির দুর্নীতি দূর করে খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। জুনিয়র ডাক্তাররা রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালাচ্ছেন,সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র ডাক্তাররা তাদের সহযোগিতা করার জন্য ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালগুলিতে সমস্ত রকম চিকিৎসার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই হাসপাতালের অতীতের ইতিহাস তুলে ধরছি।যার নামে এই হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে তার জীবন ছিল অসামান্য।
সোনার হাসপাতালের সেই কাহিনী:
বিয়ে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে একটি লোক। দেখে ভিখারী ও মনে হয় না। বেশ সৌম্য সুদর্শন চেহারা। তবুও ভিক্ষা করছেন। কেউ ভিক্ষা দিচ্ছে কেউ পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। সালটা ১৯০৪ কিংবা ১৯০৫ হবে।
কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে বিলেত গেলেন রাধা গোবিন্দ নামের এক সদ্য যুবক। সেখান থেকে এম আর সি পি হয়ে দেশে ফিরলেন। তারপর দেশে ফিরে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। আর এক গরীবের ভগবান! রোগীর ওষুধ কেনার পয়সা নেই। ফি তো নিলেন না। ওষুধের টাকাও দিলেন।
এলো কলকাতায় সেই ভয়ংকর প্লেগ মহামারী। প্রচুর মানুষ প্রতিদিন মারা যেতে লাগল। সব ভয় তুচ্ছ করে উত্তর কলকাতায় সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন এক ডাক্তার। রোগীর পরিবারকে সচেতন করছেন।
এ কাজে সঙ্গী আর একজন মহীয়সী নারী। তিনি হলেন সিস্টার নিবেদিতা। নিবেদিতাও সারাদিন চান খাওয়া ভুলে গেছেন। আর সেই বিলেত ফেরত ডাক্তার বাবু প্রখর রোদে সাইকলে চেপে পাড়ায় পাড়ায় রোগী দেখে যাচ্ছেন।
মানুষকে ভালবাসার এত নেশা! কই আমরা তো সবাই পারিনা? কি প্রয়োজন ছিল তখনকার দিনে একজন এম আর সি পি ডাক্তারের এসব করার? ঐ যে বললাম কিছু মানুষ এই পৃথিবীতে আসেন যাঁরা অন্য ধাতুতে গড়া…নবজাগরণের আলোকবর্তিকা!
তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজ হয়েছে। সেখানে ইউরোপীয় মানুষদেরই দাপট। নেটিভদের ভাল চিকিৎসা করা হয় না।
তিনি ভাবলেন, একটা মেডিকেল কলেজ যদি করা যায় তাহলে দেশের মানুষগুলো একটু চিকিৎসা পায়। কিন্তু কে দেবে এত টাকা? নিজের সব দিয়েও তো কলেজ ও হাসপাতাল করা সম্ভব নয়!
তখন নিজে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ভিক্ষা করতে শুরু করলেন বড়লোকদের দ্বারে দ্বারে। বড়লোকের বাড়িতে বিবাহের অনুষ্ঠান। বিলেত ফেরত ডাক্তারবাবু দাঁড়িয়ে আছেন গেটের সামনে.. . ” কিছু অর্থ দান করুন না? হাসপাতাল করবো.. ”
চেনেনা কেউ ডাক্তারকে! কপালে হাত ঠেকিয়ে( যেমন ট্রেনে ভিখারিদের অনেকে করে থাকে) … “যত্ত সব ফোর টুয়েন্টির দল!হাসপাতাল করবে!”… হয়’ত এসব বলতে বলতে বিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ চিনতে পেরে, ডাক্তার বাবু! আপনি? এই বলে নমস্কার করে পকেট থেকে টাকা বার করে দিচ্ছেন। এইভাবে নানাভাবে তিনি হাসপাতালের জন্য টাকা তুলতে লাগলেন।
অবশেষে একদিন স্বপ্ন সফল হল! বেলগাছিয়ায় ভারতবর্ষে প্রথম বেসরকারি আলবার্ট ভিক্টর কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করলেন। সে এক বিস্ময়! শুরু হল পথচলা…
এরপর কলেজের ছাত্রদের জন্য বাংলা ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্রের বই লিখলেন। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন দেশিয় ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা শুরু করতে পারলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
এরপর একদিন আচমকা…
১৯১৮ সালে ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় চলে গেলেন নবজাগরণের এই মহামানবটি!
মৃত্যুর আগে তাঁর সর্বস্ব দান করে গেলেন তাঁর মেডিকেল কলেজকে। রইল পড়ে শুধু বসতবাটিটুকু।
১৯৪৮ সালে তাঁর তৈরী সেই হাসপাতালেের নামকরণ করলেন আর এক ডাক্তার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
হাসপাতালটির নাম হল আজকের ” আর জি কর মেডিকেল কলেজ।”
*সেই ডাক্তারবাবুর পুরো নাম হল রাধাগোবিন্দ কর, সংক্ষেপে আর জি কর ( ১৮৫২, ২৩ অগাস্ট – ১৯১৮, ১৯ ডিসেম্বর)।* জীবনটা অন্যভাবে কাটিয়ে দিতে পারতেন না তখনকার দিনের একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার? কিন্তু ওরা যে শুধু দু’হাত ভরে উজাড় করে শুধু আমাদের বিলোতে আসেন বিনিময়ে কিছুই চান না।দুর্ভাগ্য আজ সেই হাসপাতালের কী চরম অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply