সরকারদলীয় দুর্নীতিবাজ নেতাদের অবৈধ সম্পদ খুঁজে বের করতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই অংশ হিসেবে যেসব নেতা বছরের পর বছর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন, তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
পাশাপাশি বির্ভিন্ন মাধ্যমে আসা নেতাদের অঢেল সম্পদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিট। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। আরও জানা গেছে, গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে দুদক। শুধু তা-ই নয়, সাবেক দুই মন্ত্রীর ব্যাপারে খোঁজ-খবরও নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে একটি ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত এবং আরেকজনের বিরুদ্ধে জি কে শামীমের কাছ থেকে ঠিকাদারি ব্যবসার টাকা বস্তায় বস্তায় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দুদক মনে করছে, দলের নাম ভাঙিয়ে বা পদ ব্যবহার করে যেসব নেতা অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তাদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। তারা দেশের উন্নয়ন ও সুশাসনের শত্রু। জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, দলের পদে থেকে যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামব। দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে এই অনুসন্ধান হবে। অবৈধ সম্পদ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। আমরা দেখব যাদের টাকা বের হচ্ছে, সেই টাকা লিগ্যাল সোর্সে অর্জিত কি না। গ্রেফতার হওয়া জি কে শামীমের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা তার অঢেল টাকার উৎস খতিয়ে দেখব।
সূত্র জানায়, জি কে শামীম, খালিদ ও ফিরোজের বিরুদ্ধে আজ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে অনুসন্ধান শুরু করতে যাচ্ছে দুদক। শুক্রবার র্যাবের অভিযানে যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের নিকেতনের অফিস থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসাবে রাখা ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার কাগজপত্র, ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ৯ হাজার মার্কিন ডলার ও ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয়েছে আটটি বৈধ অস্ত্র ও ২৩টি ব্যাংকের ৮৩টি চেক। এর আগে বুধবার রাতে র্যাবের একটি টিম যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পদক খালিদ মাহমুদ ভূঁয়াকে ২৫ লাখ টাকা, অবৈধ অস্ত্র, গুলি, মাদকসহ গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাসহ চারটি মামলা হয়েছে। রিমান্ডে তিনি অনেকের নাম বলেছেন, যাদের পকেটে ক্যাসিনোর টাকা গেছে।
ক্যাসিনোর শত শত কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারার সঙ্গে রাজনীতিবিদ ছাড়াও প্রশাসনের কোন স্তরের কারা জড়িত, তাদের বিষয়ে নানা মাধ্যমে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে দুদকের কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি অনুসন্ধান করতে পারবে।
শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় একের পর এক তাদেরকে ধরা হচ্ছে। সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কেউ শাস্তির বাইরে যাবে না। অভিযোগের সত্যতা থাকলে যুবলীগ নেতা সম্রাটের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। এর আগে শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বা যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দুদকও কাজ করবে।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, সরকারদলীয় অনেকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অবৈধ সম্পদসহ নানা অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদীর সাবেক ও বর্তমান দুই এমপি, খুলনার সাবেক এক এমপি, পিরোজপুর ও বরগুনার সাবেক দুই এমপি, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সাবেক এমপি, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা, যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ও সাবেক একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলের নাম দুদকের নথিতে রয়েছে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমের তালিকায়। এছাড়া চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাই, আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতিসহ অনেকের নাম আছে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের তালিকায়। দুদক বলছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতিসহ বর্তমান ও সাবেক অন্তত ‘হাফ ডজন’ এমপির বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান নথিভুক্ত হলেও পুনরায় সচল করে দেখা হবে সঠিক অনুসন্ধান হয়েছে কি না।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন চাওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগের বিদায়ী দুই নেতা ও ক্যাসিনোর ঘটনায় রাজধানীর একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামও রয়েছে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানের তালিকায়।
এদিকে গ্রেফতার হওয়া যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও দুর্নীতির অভিযোগ দুদক অনুসন্ধান করবে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে কথা বলেছেন, তাতে দুদকের সক্ষমতা আছে কি না জানতে চাওয়া হয় সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে দুদক প্রায় ২০০টি মামলা করেছে। মামলায় আসামির সাজার হার শতভাগ। তবে আইন সংশোধন করে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্তের জন্য সিআইডিসহ অপর দুটি সংস্থাকে দেয়ার পর দুদক এ কাজে বাধার মুখে আছে। অনেকেই ভাবতে পারেন, দুদক কেন বিদেশে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে বড় কিছু করছে না, তারা হয়তো এ বিষয়টি জানেন না।
তিনি বলেন, আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের মানি লন্ডারিং তদন্ত করতে পারি। এমনকি এমপিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা যায়। তবে বেসরকারি ব্যক্তিদের মানি লন্ডারিংয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তাদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে কোনো বাধা নেই। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সিআইডির হাতে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তের যে কাজটি দেয়া হয়েছে, তার এখতিয়ার দুদকের হাতেও থাকা উচিত। কারণ এটি দুদকেরই কাজ। আগে দুদকই কাজটি করত। তিনি বলেন, দুদকেও একটি শক্তিশালী মানি লন্ডারিং ইউনিট থাকতে হবে। এই ইউনিটে পর্যাপ্ত জনবলও থাকতে হবে। চলমান অভিযানে গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করবে বলে সরকারের তরফ থেকে যে কথা বলা হচ্ছে, তা যদি সঠিক হয়, তাহলে মানি লন্ডারিংয়ের আইন সংশোধন করে দুদকের হাতে দেয়া উচিত বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply