নইন আবু নাঈম বাগেরহাটঃ
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে চোরা হরিণ শিকারীদের তৎপরতা। সুন্দরবনের বাঘের চামড়া ও হরিনের মাংসসহ চামড়া পাচার এখন নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। সেই সাথে গত ২ ফেব্রুয়ারী ৪২ কেজি হরিণের মাংসসহ চোরা শিকারী বাবা-ছেলে, ২২ জানুয়ারী শরখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজার বাসস্টান্ড সংলগ্ন এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ শরণখোলা উপজেলার দুই বাসিন্দা, ১৯ জানুয়ারী সুন্দরবনের পাহারাদার হিসাবে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামরাসহ এক জেলে, ৩০ জানুয়ারী ৪৭ কেজি হরিণের মাংস দুই চোরা শিকারী ও ৩১ জানুয়ারী ২২ কেজি মাংসসহ এক চোরা শিকারী পাচারকারী গ্রেফতারের ঘটনায় উঠে এসেছে সুন্দরবনের উদ্বেগজনক চিত্র।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত ঘোষনায় সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকার কমে এসেছে বলে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন দাবী করলেও গত ছয় মাসে (জুলাই ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারীর ৩ তারিখ পর্যন্ত) বিভিন্ন সময় সুন্দরবন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ জন চোরা শিকারীকে। এসময় জব্দ করা হয়েছে ১টি বাঘের চামড়া, ২৩৪ কেজি হরিণের মাংস ও ২৫শ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ। জব্দ করা হয়েছে ৯টি নৌকা আর মামলা হয়েছে ১৮টি। এটা শুধু সুন্দরবনে ধরা পরা চোরা শিকারীদের পরিসংখ্যান। এর বাইরে চোরা শিকারিরা কি পরিমাণ হরিণ হত্যা করে মাংস চালান করেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। তবে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বলেছে বিভিন্ন সময় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে পাশপারমিট নিয়ে ছন্মবেসে থাকা এক শ্রেনীর জেলে ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারাই এই বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত। তবে শরণখোলা উপজেলার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ শুধু জেলে বনজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নয় বণ্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের সহযোগী হিসাবে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষিরাও জড়িত।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন তথ্য সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারীর ৩ তারিখ ২০২১ পর্যন্ত বনবিভাগ, পুলিশ, র্যাব ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ২৩৪ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়। এর সাথে দুই হাজার ৫২৫ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ৯টি নৌকা জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হরিণ শিকার ও বাঘ ও হরিণের চামড়া পাচারের অপরাধে গ্রেফতার হয় ২৫ চোরা শিকারি। এসব ঘটনায় করা ১৮টি মামলায় আসামি পলাতক রয়েছে ৩৭ জন। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার এ জেলে বনজীবী ও চোরা শিকারীদের কাছ থেকে গত ৬ মাসে ১০টি হরিণের মাথা, ৩০টি পা জব্দ করা হয়। গত ২০১৯ সালের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘ রয়েছে মাত্র ১১৪ টি। এর মধ্যে ২০০১ সাল থেকে এপর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মারা গেছে মাত্র ১৫টি। লোকালয়ে ঢুকে পড়া ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয় জনতা, একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডরে ও বাকী ২৭টি বাঘ বিভিন্ন সময় হত্যা করেছে চোরা শিকারীরা।
বন বিভাগের তথ্য মতে, জেলে সেজে পূর্ব সুন্দরবন থেকে পাশপারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে বিভিন্ন সময় জেলে ও বনজীবীদের আটক করা হয়েছে। এছাড়া পাশপারমিট বাদেও সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধেও আটক হয়েছে অনেকে। এর মধ্যে গত ৪ জুলাই সুন্দরবন সংলগ্ন চিলা বাজারের দক্ষিণ পশুর নদীর তীর একটি জেলে নৌকা থেকে ১৫ কেজি হরিণের মাংস ও নৌকা জব্দ করা হলেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৩জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা করলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ২৬ জুলাই সুন্দরবনের চাড়াখালি খালে দুটি জেলে নৌকাসহ ৩০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হলেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৬জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা করলেও সবাই পলাতক রয়েছে।
গত ১৫ আগষ্ট সুন্দরবনের কচিখালী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের পক্ষিদিয়া চর সংলগ্ন সংরক্ষিত বন থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার, ২০০হাত হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ২০০ হাত ইলিশ জাল জব্দসহ ৭জন জেলে (বনজীবীকে) আটক করা হয়। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। গত ২৫আগষ্ট সুন্দরবনের মরাপশুর খাল থেকে একটি জেলে নৌকা ও ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হলেও এ ঘটনাও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় ৬জনকে আসামী করে বন বিভাগ মামলা কওে এবং ৫জন আসামীর সবাই পলাতক রয়েছে।
গত ২৮ আগষ্ট সুন্দরবনের রায়বাঘিনী খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে হরিণ শিকারের ১৫০ মিটার ফাঁদ, ১টি দা ও ১টি কুড়াল জব্দ করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে ৩ চোরা শিকারীর নামে মামলা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র সংলগ্ন টহল ফাঁড়ির খালের উত্তর পাড় থেকে একটি জেলে নৌকা ও হরিণ শিকারের ৬০ ফুট ফাঁদ জব্দ করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় ৪জনকে আসামী করে মামলা করা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। একই দিন সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের পানিরঘাট অফিস সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে হরিণ শিকারের ২০০ মিটার ফাঁদ ও ১টি দা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায়ও ৩ চোরা শিকারীকে আসামী করে মামলা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর সুন্দরবনের পশুর নদী সংলগ্ন খাল থেকে ১টি নৌকা, হরিণ শিকারের ৩০০ হাত ফাঁদ, ২টি খালপাটা জাল, ৫টি ড্রাম, ৩টি দা ও ১টি কুড়ালসহ ৩ জেলেকে আটক করে সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত স্মার্ট প্রেট্রোলিং এর সদস্যরা। গত ২০ অক্টোবর সুন্দরবনের জোংড়া টহল ফাঁড়ির সীমানা খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে ১টি জেলে নৌকা থেকে ১ কেজি হরিণের মাংস ১০০ মিটার হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ৩টি বৈঠা জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ৪ জেলেকে আসামী করে মামলা করা হলেও সবাই পলাতক রয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যের জামতলা এলাকা থেকে ১টি হরিণের শিং, ৩৭৫ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ১টি দা সহ ৫ চোরা শিকারীকে আটক করে বন বিভাগ। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গত ২১ ডিসেম্বর সুন্দরবনের কুলতলি খাল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে কেজি ৮০০ গ্রাম হরিণের মাংস, ৫১টি হরিণ শিকারের ফাঁদ ও ১টি দাসহ ১জনকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে ৫ চোরা শিকারীকে আসামী করা হয়েছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply