মনিরুল ইসলাম কুমিল্লা
কুমিল্লায় দুই শতাধিক রেলক্রসিংয়ের মধ্যে বেশিরভাগই অনুমোদনহীন। জেলায় এসব অবৈধ রেলক্রসিংগুলো এখন ‘মরণ ফাঁদ’ হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয়দের দাবি, রেলওয়ের কাছে এসব রেলক্রসিংয়ের সঠিক কোনো তথ্য নেই। এছাড়া বৈধ রেলক্রসিংয়ের ক্রুটিপূর্ণ ব্যারিয়ারের কারণেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে প্রায়ই প্রাণহানি ঘটছে। এরপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে। অবৈধ এসব রেলক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও এই সমস্যা সমাধানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে চলমান থাকা কুমিল্লার লাকসাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পর্যন্ত ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় অবৈধ ১৫টি রেলক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের আওতাধীন রেলপথ এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৮৪ কিলোমিটার। ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়খালী ও লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথের মধ্যে থাকা এই বিশাল এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে লাকসাম রেলওয়ে থানা পুলিশও। এই রেলপথের মধ্যে থাকা হাতেগোণা কয়েকটি ছাড়া প্রায় ৯০ শতাংশ রেলক্রসিংয়ই অবৈধ ও অনুমোদনহীন। গত কয়েক বছরের মধ্যে এসব অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটাপড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, শুধুমাত্র অবৈধ রেলক্রসিংই নয়, অনেক বৈধ রেলক্রসিংয়ের ক্রুটিপূর্ণ ব্যারিয়ারের কারণেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। ক্রসিংয়ে দু’পাশে দু’টি ব্যারিয়ার থাকায় রং সাইড দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করছে। এতেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
গত ৩০ ডিসেম্বর কুমিল্লা নগরীর শাসনগাছা এলাকায় রেলক্রসিংয়ে রং সাইড দিয়ে প্রবেশ করে একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে অটোরিকশার যাত্রী স্বামী-স্ত্রী ঘটনার দিন এবং তাদের মেয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর মারা যায়।
১৮৪ কিলোমিটার রেলপথে কতগুলো বৈধ ও অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে জানতে চাইলে লাকসাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘বিশাল এই এলাকায় কতগুলো রেলক্রসিং রয়েছে এর সঠিক কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বেশিরভাগ রেলক্রসিংই অনুমোদনহীন।’
বিভিন্ন সূত্র জানায়, লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন ওই রেলপথ এলাকার মধ্যে মোট ১১৭টি রেলক্রসিংয়ের হিসাব রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৪টি রেলক্রসিং বৈধ। তবে বৈধ ওই ৩৪টির কয়েকটিতে গেট ও গেটম্যান নেই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব স্থানে নিজ দায়িত্বে পারাপারের জন্য সতর্কবার্তা লিখে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। তবে অরক্ষিত এসব রেলক্রসিংয়ে সতর্কবার্তা দিলেও থামছে না দুর্ঘটনা।
লালমাই উপজেলার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জানান, রেললাইনের ক্রসিং সংলগ্ন জমি অবৈধভাবে দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। যার কারণে অনেক সময় পথচারী ও যানবাহন চালকদের ট্রেন চলাচল চোখে পড়ে না। এতে প্রতিটি অবৈধ রেলক্রসিং এক একটি মরণ ফাঁদ হয়ে পড়েছে।
রেলওয়ে কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পথ বিভাগ) লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত মোট ৭১টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ৫৮টি অবৈধ ও ১৩টি বৈধ ক্রসিংয়ে রেলওয়ের গেটম্যান রয়েছেন। ডাবল লাইন প্রকল্পের আওতায় আরও ১৫টি অবৈধ রেলক্রসিংয়ে জনবল নিয়োগ করা হবে। এছাড়া আগের ক্রসিংয়ে দু’পাশে দু’টি ব্যারিয়ার দেয়া হতো। নতুনগুলোতে দু’পাশে দু’টি করে চারটি ব্যারিয়ার দেয়া হবে। এর ফলে যানবাহন রং সাইড দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
জেলার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে ১৮ এপ্রিল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডাবল রেললাইনে ট্রেন চলাচল শুরু করেছে। এতে ওই রেলপথে আগের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে ট্রেন চলাচল করছে। ৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল এই রেলপথে হাতেগোণা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ রেলক্রসিংগুলোতে কোনো গেট ও গেটম্যান নেই। এতে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দ্রুত এসব বিষয়ে রেলওয়েকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
লাকসাম রেলওয়ের সূত্র জানায়, লাকসাম রেলওয়ের আওতাধীন ১৮৪ কিলোমিটার এলাকায় গত ৩ বছরের মধ্যে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময় দেখা যায় দুর্ঘটনা বা হতাহতের খবরও রেলওয়ে পুলিশের কাছে এসে পৌঁছায় না। স্থানীয়রা নিজেরাই লাশ উদ্ধার করে দাফন করে ফেলেন। আর এসব প্রাণহানির বেশিরভাগই হয়েছে অবৈধ রেলক্রসিংয়ের জন্য। এছাড়া রেলওয়ের পক্ষ থেকে এই এলাকায় দেড় শতাধিক রেলক্রসিংয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর সংখ্যা হবে প্রায় ৪ শতাধিক। কারণ অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে চলাচল করছে।
এ প্রসঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, লাকসাম থেকে আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পে বেশ কয়েকটি স্থানে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সকল রেলক্রসিংগুলোতে গেট নির্মাণ এবং গেটম্যান নিয়োগ দেব। এখন মানুষকে সচেতন হয়ে চলাচল করতে হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply