আনোয়ার হোসেনঃ
চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে পুলিশের জিরো টলারেন্স চলমান কঠোর অ্যাকশানে স্বস্তি ফিরেছে। কোনো বাধা ছাড়াই এগুচ্ছে যশোরে বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ কাজ। ইট খোয়া বালি কিনতে আর ধরা বাধা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান নেই। সব মিলিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে পাল্টে গেছে চিত্র। বিশেষ করে হাতেনাতে দাগী ডজনখানেক চাঁদাবাজ আটক হওয়ায় কারো ছাড় নেই এমন মেসেজ পৌঁছে গেছে সব শ্রেণির অপরাধীদের কাছে। এ ধারা ও পুলিশি অ্যাকশান অব্যাহত রাখার দাবি ভুক্তভোগীদের।
যশোরের বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র চাঁদাবাজির নয়া কৌশল হিসেবে বাজার ছাড়া চড়া দামে ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামাল কিনতে বাধ্য করছিল নির্মাণকারীদের। সাপ্লাইয়ার বা ব্যবসায়ী নাম ধারণ করে বাড়ি নির্মাণকারীদের মালামাল নিতে বাধ্য করে আসছিল এসব চক্র। তাদের কাছ থেকে মালামাল নেয়া না হলে দুর্বৃত্তরা বাড়ি তৈরিতে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল। এছাড়া এলাকার ছেলেরা ‘মিষ্টি মুখ’ করবে এমন ধুয়ো তুলে শহর, শহরতলী ও পাড়া মহল্লায় চাঁদা আদায় করে আসছিল চিহ্নিত সংঘবদ্ধরা। শহরের শতাধিক স্পটে রাস্তা দখল করে চক্রগুলো ইট বালি খোয়ার স্তুপও মজুদ করে। এসব তথ্যে মাঠে নামে যশোরের নবাগত পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার। যশোরকে স্বাভাবিক, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে সময়োপোযোগী উদ্যোগ নিয়ে তিনি সিনিয়র অফিসারদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব দেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অপরাধ সালাহ উদ্দিন শিকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডিএসবি তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রব্বানীসহ সংশ্লিষ্ট সব অফিসারকে এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেন তিনি।
চাঁদাবাজ রুখে দেয়ার অংশ হিসেবে যশোর শহর ও শহরতলীর ২৩ টি বিট পুলিশিং কেন্দ্রের কার্যক্রম আরো জোরদার করার পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব ইন্সপেক্টরগণ তাদের আওতাধীন স্ব স্ব মহল্লায় বাড়ি নির্মাণ কাজের তদারকি করা শুরু করেছেন। এছাড়া যশোর শহরের ৯০টি নির্মাণাধীন বাড়িতে পুলিশের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে কোতোয়ালি থানার ওসি ও পুলিশ সুপারের মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। ওই নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজে কোনো বাঁধা হচ্ছে কি না তা তদারকি করছেন বিট পুলিশিংয়ের অফিসার। এছাড়া কোতোয়ালি থানা, ফাঁড়ি পুলিশ বা ডিবি পুলিশকে তদারকি করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো অভিযোগ পেলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়ার পর থেকে ওই ভার্সনের চাঁদাবাজির তথ্য আসেনি থানায়। বরং পুলিশের সাইনবোর্ড পেয়ে বাড়ি নির্মাতারা সাহসী বোধ করছেন। সতর্কীকরণ বোর্ড দেখে অনেকে ভোল পাল্টে আত্মগোপনেও রয়েছে।
যশোর শহরের আরবপুর, পালবাড়ি, খড়কী, মুড়লী, চাঁচড়া, পুরাতন কসবার কাঁঠালতলা, ঘোষপাড়া, নিউ মার্কেট, বেজপাড়া, ধর্মতলা, পিটিআই রোড ও ষষ্টিতলাপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় কথিত ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামাল সাপ্লাইয়ার বা ব্যবসায়ী নাম ধারণ করে যারা বাড়ি নির্মাণকারীদের মালামাল নিতে বাধ্য করছিল তাদের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
এ ব্যাপারে যশোর ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের নিকুঞ্জ মোড়ে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের মালিক অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক মানিক মিয়া জানিয়েছেন, চাঁদাবাজদের সতর্ক করে তার নির্মাণাধীন ভবনেও পুলিশ সাইনবোর্ড দিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত চাঁদাবাজদের দেখা পাননি তিনি। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের রুখতে পুলিশ যে কাজ করছে তা নিঃসন্দেহে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
এদিকে, গত কয়েক সপ্তাহে চিহ্নিত ডজনখানেক চাঁদাবাজ হাতেনাতে আটক হওয়ায় গোটা অপরাধীদের মধ্যে মেসেজ গেছে, এখন থেকে অনাচার কিংবা যথেচ্ছা করা যাবে না। চাঁদাবাজি চলবে না, তা যে স্টাইলেই হোক।
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চুড়ামনকাটি যাত্রী ছাউনীর সামনে সিএনজি-ইজিবাইক স্ট্যান্ডে সিএনজি ও ইজিবাইক চালকদের কাছ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদার টাকা আদায় করার সময় আটক করা হয় ৩ জনকে। এরা হচ্ছে সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলার আমীর হামজার ছেলে মাহামুদ হাসান, একই এলাকার মৃত আবুল হোসেন সরদারের ছেলে ওহিদুল ইসলাম, চুড়ামনকাটি গ্রামের মৃত আব্দুল বারীর ছেলে মাহাবুব হাসান দিপু। যশোরের ঘুরুলিয়ার আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতে গুলি করতে উদ্যত হওয়ার সময় আটক হয় চিহ্নিত ৩ চাঁদাবাজ। অস্ত্রসহ আটক হওয়া ওই ৩ জন আরো ৬ জনের নাম বলে, যারা পলাতক রয়েছে।
২ মার্চ যশোরের বেজপাড়ায় ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আনতে গিয়ে আটক হয় রফিকুল ইসলাম ওরফে রয়েল রফিক (৩০) নামে একাধিক মামলার এক আসামি। আহত অবস্থায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। সে রেলগেট এলাকার মৃত মনিরুজ্জামানের ছেলে। ওই ঘটনায় জড়িত অন্যদের আটকে অভিযান চলে। ৯ মার্চ ফুড গোডাউন এলাকার পাশে মুদি দোকানী এরশাদ আলীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ২ লাখ টাকার চেক নেয় সন্ত্রাসীরা। আরো ৩ লাখ টাকা নেয়ার জন্য তাকে অপহরণ করে মারপিট করে। এদিকে সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ আগ্নেয় ও ধারালো অস্ত্র এবং ৪ সহযোগীসহ আলোচিত সন্ত্রাসী রেলরোড খাটপট্টির রাব্বি ইসলাম শুভ আটক হয়। এসময় আরো আটক হয় শহরের রেলরোড ফুড গোডাউনের পাশের ইমান আলীর ছেলে সবুজ হোসেন, রামনগর রাজারহাট মোড়ের রহিম ড্রাইভারের ছেলে হিমেল হোসেন, রেলরোড ফুড গোডাউনের দক্ষিণ পাশের ফরিদ হোসেনের ছেলে রায়হান ও সদর উপজেলার ফরিদপুর পুরাতন বাজার এলাকার আব্দুস সালামের মেয়ে প্রিয়া। একে একে এমন দাগী আটক হওয়ায় ইতিমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে নয়া এসপির উদ্যোগে।
এ ব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডিএসবি তৌহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গোলাম রব্বানী জানিয়েছেন, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। দলমত নির্বিশেষে চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশানে রয়েছে পুলিশ। স্বাধীনভাবে নির্মাণকারীরা তাদের মালামাল কিনবে। পছন্দমত কিনবে। কোনো অপতৎপরতা কিংবা জবরদোস্তির শিকার হলে পুলিশকে জানাবে। অপরাধ করলে কারো ছাড় নেই। এ ব্যাপারে পুলিশকে তথ্যগত সহায়তা করার আহবান জানান।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply