নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আনোয়ার হোসেন যশোর থেকে।
যশোর জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, দেশের জনগণকে ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কাজ করছেন জেলা প্রশাসনসহ “টিম যশোর” এর সব বিভাগের কর্মকর্তারা। বেনাপোল বন্দরে সব যাত্রীর পাসপোর্ট রেখে পুলিশের পাহারায় গাড়িযোগে যশোর জেলা এবং খুলনা বিভাগের অন্য জেলায় প্রতিষ্ঠিত কোয়ারেন্টিন সেন্টারে প্রেরণ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের একজন এডিসির নেতৃত্বে প্রতিদিন প্রশাসনের এই দুইজনসহ একঝাঁক তরুণ কর্মকর্তা প্রতিদিন পালাক্রমে সব যাত্রীর কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে আরও আছেন পোর্ট থানার ওসি মামুন খান এবং নাভারণ সার্কেলের এএসপি জুয়েল ইমরান। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এ কাজটি কতটা ক্লান্তিকর তা সরাসরি না দেখলে বুঝা যাবেনা।
রাসনা শারমীন মিথি, এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত শার্শা উপজেলায়। করোনার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বেনাপোল স্থলবন্দরে ভারত ফেরত বাংলাদেশি যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসছেন।
গত ২৬-২৭ এপ্রিল থেকে একটানা সকাল ৭টা থেকে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত বেনাপোল পোর্ট এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হতে আগত বাংলাদেশিদের দুই সপ্তাহের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এ নিশ্চিত করা।
কোভিডি-১৯ মহামারির সাম্প্রতিক ঢেউ ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছে এবং ভারতীয় ভেরিয়েন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ট্রিপল মিউটেন্ট করোনা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে যাত্রী চলাচলে সাধারণ নিষধাজ্ঞা আরোপ করা আছে।
তবে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে যাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে তারা কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন থেকে এনওসি সংগ্রহ করে দেশে আসতে পারবেন তবে দেশে আসার পরে আবশ্যিকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিজ খরচে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে থাকতে হবে।
বিশেষ অনুমতিতে গত ৬ মে পর্যন্ত ভারত ফেরত যাত্রীদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২২০৩ জন। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২৫০-৩০০ জন যাত্রী এ সময় বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, যাহা অন্য স্বাভাবিক সময়ে আসা যাত্রীর সমান। আগতদের মধ্য কোভিড পজিটিভ রোগীও রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে দেশে ফেরার পর ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধ এবং নিজ খরচে তা তারা মানতে নারাজ।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের বাধ্য করায় মারাত্মক তোপের মুখে পড়েছেন, অকথ্য গালি গালাজ এমনকি মারতে পর্যন্ত উদ্যত হয়েছেন। অনেকের হইচই চেঁচামেচি কান্নাকাটিতে যাদের জেনুইন সমস্যা আছে এমন অনেকে নিজের সমস্যা প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
অত্যন্ত চটপটে প্রশাসনের নারী কর্মকর্তা রাসনা এ কাজটি করে যাচ্ছেন পবিত্র রমজান মাসে যশোরের শার্শা উপজেলায় এ বছরের ৪০ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রা মধ্যো নিয়ে। তাকে এ কাজে সাহায্য করছেন জেলা প্রশাসকের সহকারী কমিশনার ডা. মাহমুদুল হাসান।
জেলা প্রশাসনের একজন এডিসির নেতৃত্বে প্রতিদিন প্রশাসনের এই দুইজন সহ একঝাঁক তরুণ কর্মকর্তা প্রতিদিন পালাক্রমে সব যাত্রীর কোয়ারেন্টিন এ দেখা শোনা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে আরও আছেন পোর্ট থানার ওসি মামুন খান এবং নাভারণ সার্কেলের এএসপি জুয়েল ইমরান। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এ কাজটি কতটা সমস্যা এবং ক্লান্তিকর তা সরাসরি না দেখলে বোঝা যাবে না।
স্থানীয় বেনাপোল পৌর এলাকার হোটেল, সহ যশোর সদরের হোটেল এবং ঝিকরগাছা উপজেলার গাজীর দরগাহ মাদ্রাসাকে কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যশোর সদরে সর্বশেষ ব্যক্তিকে হোটেলে পৌঁছে দিতে কর্মকর্তার রাত ১২টা পার হয়ে যায়। যশোর শহরের প্রতিটি হোটেলের দায়িত্ব জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ট্যাগ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এছাড়াও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত পরিদর্শন ও মনিটর করছেন।
নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক অঙ্গীভূত আনসার সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে এবং পুলিশের বিশেষ টহল ও পাহারার ব্যবস্থাও রয়েছে। একইভাবে বেনাপোল পৌরসভার হোটেলগুলোতেও আনসার নিয়োগ করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন বিভাগের সরকারী কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। বেনাপোল ও যশোর শহরের সকল হোটেল মালিকগণকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে রুমভাড়া অর্ধেক রাখার জন্য এবং তারা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। আগত যাত্রীদের খাবারের ব্যবস্থাও সংশ্লিষ্ট হোটেলে করা হয়েছে। যাদের আথিক খরচ কম তাদের রাখা হয়েছে ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ মাদ্রাসায়।
এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতার সহযোগিতায় ২০২০ সালে এখানে কোয়ারেন্টিনের আয়োজন ছিল জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। এ বছর জেলা প্রশাসনের অনুরোধে এখানে ব্যাটালিয়ন আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। ঝিকরগাছার ইউএনও করোনা পজিটিভ হওয়ায় সেখান কার প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন এসিল্যান্ড ডা. নাজিব।
২০২০ সালের উল্লেখ করা জরুরি এজন্য যে, এই প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিগত বছর ঝিকরগাছার রাস্তায় সেনাবাহিনীসহ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত দায়িত্ব পালনকালে দুর্বৃত্তরা তার ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যায় এবং তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে সরকারি দায়িত্ব পালন করলেও এখনো ক্রাচে ভর দিয়েই চলাফেরা করেন।
ধারণক্ষমতা একপর্যায়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে যশোর জেলা প্রশাসক বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে পুলিশ সুপার প্রলয় জোয়ারদার এবং সিভিল সার্জন ডা. শাহীনের সার্বিক সহযোগিতায় ‘টিম যশোর’ দেশের জনগণনকে ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট ভয়ংকর ভেরিয়েন্ট কোভিড ১৯ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছেন।
যশোরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা একটি যুদ্ধ হিসেবে দেখছেন। জাতীয় স্বার্থে এ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন এই মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যশোরের সব বিভাগের সার্বিক সমন্বয় এবং টিম ওয়ার্কের ফলেই কাজটি বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে।
যশোর জেলায় ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন এনডিসি এগিয়ে আসলেন। ডিআইজি, খুলনা এবং স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকসহ সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনসহ সভা করে সিদ্ধান্ত নিলেন জাতীয় স্বার্থে সবাই মিলে এ গুরুদায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবেন।
প্রথমে বেনাপোল যশোরের পর খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ঝিনাইদহ- এই চার জেলা এবং বাগেরহাট, মাগুরা ও কুষ্টিয়া জেলায় কোয়ারেন্টিন সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে প্রথম চারটি জেলায় প্রতিষ্ঠিত সেন্টারে যাত্রী পাঠানো হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বাকি তিনটিতে পাঠানো হবে।
প্রায় ২২০৩ জন যাত্রী বেনাপোল বন্দর দিয়ে আসলেও গত ৬ মে পর্যন্ত নন-কোভিড হিসাবে আগত কোনো যাত্রীর সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায় ঈদুল ফিতর বা অন্য কোনো কারণে যদি একদিনে অনেক বেশি সংখ্যক (৫০০ বা ততোধিক) যাত্রী এসে পড়েন তাহলে সবাইকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো কঠিন হয়ে পড়বে। যাতে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার কাজ করতে না হয় সেজন্য ইমিগ্রেশনের সময় দুপুর ২টা পর্যন্ত করারও প্রস্তাব হয়েছে।
বর্তমানে জেলা প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তাদের দুই ভাগে ভাগ করে এক গ্রুপকে ত্রাণ কার্য পরিচালনা এবং অপর গ্রুপকে কোয়ারেন্টিন এ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সার্বিক কাজ সম্পাদনের জন্য পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যশোরে পদায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রাসনা শারমীন মিথি জানান, করোনাকালীন ভারত ফেরত যাত্রীদের সেবা দিতে দিন রাত কাজ করেছি জাতীয় স্বার্থে। দেশকে নিরাপদ রাখতে বেনাপোল দিয়ে ১৮ জন করোনা রোগীসহ প্রায় দেড় হাজার ভারত ফেরত যাত্রীদের নিরাপদে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখতে পেরেছি। তবে সার্বিক কাজে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে পড়েছে ভিআইপিদের তদবির। বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন অজুহাতে কোয়ারেন্টিন হতে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন শত শত টেলিফোন রিসিভ করতে হয় জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে এখনও পর্যন্ত মেডিকেল গ্রাউন্ডে উন্নত চিকিৎসার জন্য বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ ব্যতীত কাউকেই ছাড়া হয়নি।
১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে তারা ফিরতে পাবেন তাদের পাসপোর্ট। বিশেষ বিবেচনায় আসা যাত্রীর সংখ্যা হ্রাস না পেলে এবং আগত যাত্রীদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা যদি সংক্রমিত হন তবে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় যশোর জেলার চিকিৎসার অবকাঠামো।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply