এম শহিদুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ
বর্ষার শুরুতেই প্রমত্তা যমুনা টাঙ্গাইলের চার উপজেলায় হানা দিয়ে শতাধিক বাড়িঘরসহ, গিলে খেলো রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল ও ফসলি জমি।
ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরি ভিত্তিতে ফেলা জিওব্যাগও থামাতে পারেনি যমুনার ভয়াবহ থাবা।যমুনার প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিতে এক রাতেই শতাধিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, কালিহাতী, নাগরপুর ও ভূঞাপুর উপজেলায় বর্ষার শুরুতেই যমুনার ভাঙন শুরু হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে ভাঙন শুরু হলেও গত বুধবার (৭ জুলাই) থেকে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) এক রাতেই শুধুমাত্র সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের শতাধিক বাড়িঘর, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল ও হাট, যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এ ভাঙ্গনে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের সাথে বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ সড়কের (শেখ হাসিনা সড়ক) একাংশ যমুনার পেটে চলে গেছে। এছাড়ার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের মাকরকোল, কেশবমাইঝাইল, তিতুলিয়া, নয়াপাড়া, কুকুরিয়া, বারবাড়িয়া, কাতুলী ইউনিয়নের দেওরগাছা, রশিদপুর, ইছাপাশা, খোশালিয়া, চানপাশা ও নন্দপাশা, হুগড়া ইউনিয়নের মসপুর, বারবেলা, চকগোপাল ও কচুয়া নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এদিকে কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আলীপুর, ভৈরববাড়ী। নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের পাইকশা মাইঝাইল, খাস ঘুণি পাড়া, খাস তেবাড়িয়া, চর সলিমাবাদ, ভূতের মোড়, ভারড়া ইউনিয়নের শাহজানি, ভারড়া, পাঁচতারা, আগদিঘলীয়া। ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের ভালকুটিয়া এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা চড়ম আকার ধারন করছে।
সরেজমিনে সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের উত্তর চরপৌলী, দশখাদা, হাটখোলা, পানিকোড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চরপৌলী হাটখোলা সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাটখোলাটি রার জন্য জরুরী ব্যবস্থা হিসেবে ৩০০মিটার এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে। জিওব্যাগগুলোও যমুনার তীব্র স্রোতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বার বার জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতী উপজেলার সীমান্ত এলাকা উত্তর চরপৌলী ও আলীপুর গ্রামের অংশে অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়ক (নর্দান প্রজেক্ট) এর ১০০ মিটার এলাকায় ফেলা জিওব্যাগ ধ্বসে গিয়েছে। ইতোমধ্যে সড়কটির ৫/৬’শ মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। কাকুয়া ইউনিয়নের উত্তর চরপৌলীর নুরুল ইসলামের দেড় একর জায়গায় স্থাপিত তাঁত ফ্যাক্টরি, ঠান্ডু মিস্ত্রির স’মিল, একই এলাকার আ. জলিল, আ. বাতেন, আব্দুস সামাদ, মো. ইসমাইল, মোতালেব হোসেন, আব্দুল খালেক প্রমাণিক, আব্দুল আলিম, আব্দুর রহিম, বাবুল মোল্লা, নুর আলম মোল্লা, আব্দুল্লাহ, আবু বকর, আব্দুল মান্নান, লালচান মিয়া, মেকাম্মেল হক, শামসুল আলম, শাহ আলম, নজরুল ইসলাম, দশখাদা ও হাটখোলা এলাকার নুরুন্নাহার বেগম, মিনা আক্তার, সোনা খা, শিবলু তালুকদার, আলেয়া বেগম; পানকোড়া ও কবরস্থানপাড়ার মন্টু শেখ, মো. রোশনাই মিয়া, আব্দুস ছবুর, আনছের মন্ডল, গোলাপ খা, আব্দুল গফুর মন্ডল ও আজিজ মন্ডল সহ শতাধিক বাড়িঘর ও ফসলি জমি ভাঙনের শিকার হয়ে যমুনা গর্ভে চলে গেছে।
উত্তর চরপৌলী গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, দেড় একর জায়গায় তার তাঁত ফ্যাক্টরি ছিল। ফ্যাক্টরিতে ৫০টি পাওয়ারলোম চালু অবস্থায় ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে যমুনার ভাঙনের কবলে পড়ে। তিনি শ্রমিকদের নিয়ে ফ্যাক্টরির তাঁতগুলো কোনো রকমে সরিয়ে নিতে পারলেও ঘরটি নদীর পেটে চলে গেছে।
হাটখোলা এলাকার গৃহবধূ মিনা আক্তার বলেন, তাদের ৬০ শতাংশের বসতবাড়ি ছিল। সাম্প্রতিক ভাঙনের শিকার হয়ে এখন ১২-১৩ শতাংশ ভূমির উপর মাত্র একটি ঘর টিকে আছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে সেটাও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। তারা বর্তমানে চরপৌলী খামার পাড়া এলাকায় সরকারি খাস জমিতে বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ করছেন।
কবরস্থান পাড়ার আব্দুল গফুর মন্ডল ও আজিজ মন্ডল বলেন, হঠাৎযমুনা বিুব্ধ হয়ে প্রলয়ঙ্করী তান্ডব চালিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ৬০ শতাংশের বাড়িঘর নদীর পেটে চলে গেছে। তারা পাশের হাটে বাজার সদাই করার অবস্থায় চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখেন তাদের বাড়িঘর নেই। মুহূর্তের মধ্যে যমুনা গ্রাস করে নিয়েছে।
কাকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ভাঙনের শিকার হয়ে তার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত ৩-৪ দিনের ভাঙনে ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম চরপৌলীর বহু স্থাপনা ও বাড়িঘর যমুনা গিলে খেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনরোধে জিওব্যাগ ফেললেও তা কোনো কাজে আসছে না। তারা সদর উপজেলার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের গোলচত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের বিশাল এলাকা প্রতিবছরই যমুনার ভাঙনের শিকার হয়। এ ভাঙনরোধে তিন বছর আগে একটি স্থায়ী বাঁধের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছরেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি ফলে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply