নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আনোয়ার হোসেন।
ভারতের বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে বাংলাদেশ বেনাপোল স্হল বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় আমদানি পণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাত হাজার ট্রাক। পণ্যবোঝাই নিয়ে এক একটি ট্রাক এক মাসেরও বেশি দিন ধরে পড়ে আছে পার্কিংয়ে। সেখানে পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। ফলে দুই’দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং রাজস্ব আয় বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেনাপোল স্হল বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের নিজ মালিকানাধীন কালিতলা পার্কিং। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলো পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ করপোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে ওই নিজ পাকিংয়ে পার্কিং চার্জের নামে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে দুই’দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম বেড়েই।চলেছে আমদানি বাণিজ্য কমে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করেছে বেনাপোল।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ভারতীয় কাস্টম,ওপেট্রাপোল বন্দর সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে। তবে কোনো বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে একাধিকবার পত্র দিয়ে জানিয়েছেন। তারপরও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল স্হল বন্দর দিয়ে দুই দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের জটিলতা তৈরি করেছে ট্রাক থেকে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার চাঁদা। চাঁদার পুরো টাকাটাই পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশি আমদানিকারকদের। ফলে বাংলাদেশে একটি আমদানি পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রবেশ করতে সময় লাগছে ৩০ থেকে ৩৫ দিন। চাঁদা আদায়ের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ট্রাক থেকে মোটা অংকের টাকা চাঁদা আদায় ও পণ্য প্রবেশে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বড় বড় আমদানিকারক গন বেনাপোল স্হল বন্দর ব্যবহার ছেড়ে দিচ্ছেন।
বেনাপোল স্হল বন্দর সূত্র জানায়, এস্হল বন্দর দিয়ে প্রতি বছর ভারতের সঙ্গে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে থাকে বেনাপোল কাস্টম হাউজ। যদিও চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেনাপোল কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ছয় হাজার কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ ট্রাক পণ্য আমদানি হতো ভারত থেকে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০। ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পেট্রাপোলে প্রবেশের আগে এক মাসেরও বেশি সময় আটকে রাখা হয় বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে। প্রতিটি ট্রাক থেকে ডেমারেজ বাবদ দুই হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে প্রতিদিন। এছাড়া জরুরি পণ্য চালান আনার জন্য সিন্ডিকেটকে দিতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বনগাঁ ও পেট্রাপোল স্থলবন্দরে সিন্ডিকেট কর্তৃক অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কারণে অযৌক্তিক বিলম্ব বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তারা এ সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই বলছে তারা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে ওপারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবে দেখা না হলে এ সমস্যার সমাধান কখনো হবে না। কারণ আদায় করা অর্থের ভাগ চলে যায় বিভিন্ন মহলে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের ওপারে বনগাঁ পৌরসভার সাবেক মেয়র শংকর আঢ্য ‘কালিতলা পার্কিং’ নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্কিং তৈরি করেন। সরকারি পার্কিংয়ের চেয়ে এটি আকারে বড়। তার লোকজন মোটামুটি জোর করেই আমদানি পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো সেখানে প্রবেশ করাতেন। গত জুন মাসে বর্তমান মেয়র গোপাল শেঠ দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের মেয়রের পথেই হাঁটছেন। প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি পার্কিং খরচ নেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে। পণ্যবাহী ট্রাক পার্কিংয়ে যে কয়দিন থাকবে সে কয়দিনের টাকা ভারতের রফতানিকারকরা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ওখান থেকে প্রতিদিন কত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে আমদানি করা পণ্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানায়, বেনাপোল স্হল বন্দর দিয়ে এ পথে পণ্য আমদানি করতে বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে একটি শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে তার লোকজন প্রতিটি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছেন। পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক ৩০ থেকে ৩৫দিন ওপারে আটকে থাকলে তাকে ৬০ হাজার রুপি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকরা মোটা অংকের আর্থিক লোকসানে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। বারবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনার সহ দুইদেশের বিভিন্ন মহলে জানানোর পরও বিষয়টির সুরাহা হচ্ছে না।
ভারতের পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, বনগাঁও পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সিরিয়ালের নামে এসব ট্রাক কালিতলা পার্কিংয়ে ঢোকানো হচ্ছে। এ চাঁদাবাজি বন্ধ হলে বাংলাদেশে দ্রুত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বেনাপোল কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, দেশের ৭৫ ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আসে বেনাপোল স্হলবন্দর দিয়ে। তবে আমদানিতে জটিলতার কারণে এসব পচনশীল পণ্য নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক আমদানিকারক এ বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরমুখী হচ্ছেন।
বেনাপোল কাস্টম কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ভারতীয় পেট্রাপোল বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে বর্তমানে প্রায় সাত হাজার পণ্যবোঝাই ট্রাক আটকে আছে বলে আমদানি কারক ব্যবসায়ীগণের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আমরা রাজস্ব আয় ও ট্রাক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারতীয় কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেই যাচ্ছি।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply