টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের বনের গাছ থেকে ঝরেপড়া মরা পাতায় জীবনের সতেজতা খুজে পাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বনের গাছ থেকে ঝড়া পাতা সংগ্রহের পর বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন সহস্রাধিক পরিবার। এতে যেমন বনে আগুন লাগার শঙ্কা কমছে, তেমনি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। চলছে জীবনের স্পন্দন।
জানা গেছে, জামালপুর জেলার দক্ষিণ অংশ, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা উপজেলা, টাঙ্গাইল জেলা ও গাজীপুর জেলার বনভূমি নিয়ে মধুপুর গড় অঞ্চল গঠিত। গড়াঞ্চলের উত্তর অংশ মধুপুর গড় ও দক্ষিণ অংশ ভাওয়াল গড় হিসেবে পরিচিত। টাঙ্গাইল বন বিভাগের আওতায় ৯টি রেঞ্জে ৩৪টি বিট, তিনটি সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ৯টি সামাজিক বনায়ন কেন্দ্র রয়েছে।
মধুপুর গড়াঞ্চলে টাঙ্গাইল বন বিভাগের রেঞ্জগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ, ধলাপাড়া রেঞ্জ, হতেয়া রেঞ্জ, বহেড়াতলী রেঞ্জ, বাঁশতৈল রেঞ্জ, অরণখোলা রেঞ্জ, মধুপুর রেঞ্জ, দোখলা রেঞ্জ ও মধুপুর জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জ। এর মধ্যে মধুপুর গড়াঞ্চলের মির্জাপুর, সখীপুর, কালিহাতী, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় প্রাকৃতিক ও সৃজিত উডলট বাগান রয়েছে। মধুপুর ও ঘাটাইল উপজেলার প্রাকৃতিক বনে সবচেয়ে বেশি শাল-গজারি ও সেগুন গাছ পাওয়া যায়।
মধুপুর গড়ের জয়নাগাছা, পীরগাছা, চুনিয়া, ফেকামারী, লুহুরিয়া, অরণখোলা, কামারচালা, সানিয়ামারী, ভুটিয়া, গাছাবাড়ি, ফুলমালিরচালা, বাঁশতৈল, কাকড়াজান, যোগীরকোফা, বহেরাতলী, ঝড়কা, ঘোড়ামারা, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, চৌরাসা, বটতলী ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত শাল-গজারি গাছের ঝরাপাতা সংগ্রহ করছেন। এরপর ঘোড়ার গাড়ি বা ভটভটিতে খাঁচা তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছেন পাতা। সংগ্রহ করা পাতাগুলো তারা আনারস চাষিদের কাছে প্রতিগাড়ি (৮-১০ মণ) ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি করছেন।
মধুপুরের চুনিয়া বন থেকে পাতা সংগ্রহকারী শোলাকুড়ি গ্রামের মফিজুল ইসলাম জানান, তিনি পেশায় কৃষিজীবী। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত কোনো কাজ না থাকায় বন থেকে ঝরাপাতা সংগ্রহ করে আনারস চাষিদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তিনি এক গাড়ি পাতা সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে পারেন। ওই ঝরাপাতা বিক্রির টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচও বহন করতে পারছেন। ঝরাপাতা সংগ্রহ আর বিক্রি করতে না পারলে পরিবার নিয়ে বিপদে পড়তেন বললেও জানান তিনি।
হাতিমারা গ্রামের আমির হোসেন জানান, বছরের অন্য সময় তিনি দিনমজুরি করেন। মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বনের ঝরাপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন।
সোনাতন গ্রামের বাদশা মিয়া জানান, তিনি পেশায় দিনমজুর। তার বড় মেয়ে ভাবনা এইচএসসিতে পড়াশোনা করে। মেয়ের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ যোগাতে তিনি বন থেকে পাতা সংগ্রহ ও বিক্রি করছেন।
তবে তার অভিযোগ, ঝরাপাতা সংগ্রহ করতেও পুরো সিজন (মৌসুম) অর্থাৎ মাঘ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বন বিভাগের কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কারদের (সিএফডব্লিউ) আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা নগদ দিয়ে বনে ঢুকতে হয়। টাকা না দিলে কাউকে বনের ঝরাপাতা সংগ্রহ করতে দেওয়া হয় না। প্রতিবাদ করতে গেলে বন আইনে মামলা দেওয়ার ভয়ভীতি দেখানো হয়।
মধুপুরের আনারস চাষি আবুল কালাম, মজিবুর রহমান, আব্দুল লতিফ, রহমান মিয়াসহ অনেকেই জানান, জমিতে আনারসের চারা লাগানোর পর মাটির আদ্রতা রক্ষা ও আগাছা গজানো রোধ করতে বনের ঝরাপাতা বিছিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় দিনমজুররা ওই পাতা বন থেকে সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। আকার ভেদে প্রতিগাড়ি পাতা ৮০০ থেকে ১২শ’ টাকা দিয়ে কিনতে হয়।
টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়াঞ্চলের ওই বন থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবার পাতা সংগ্রহ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন মধুপুরের দোখলা রেঞ্জ অফিসার মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, বনের ঝরাপাতায় আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কাঠ চোররা বনের গাছ কেটে নিয়ে যায়। ঝরাপাতা সরিয়ে নিলে আগুন দিতে পারে না। তাই তারা স্থানীয়দের ঝরাপাতা সংগ্রহে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনের গাছ রক্ষায় ঝরাপাতা সরানো খুব প্রয়োজন। তাই পাতা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। এরপরও মাঝে মাঝে চোরের উপদ্রব লক্ষ করা যায়। এজন্য সিএফডব্লিউরা দিনরাত বনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সম্প্রতি চোরদের ধাওয়া করে তারা বেশকিছু কাঠ জব্দ করেছেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঝরেপড়া পাতা বনেরও অনেক উপকারে আসে। পাতা পচে জৈব সার সৃষ্টি হয়। যা বনে চারাগাছ জন্মাতে সাহায্য করে। তেমনি ঝরেপড়া পাতায় আগুন দিয়ে গাছ চুরির শঙ্কা রয়েছে। বনে ঝরেপড়া পাতা সংগ্রহ আর বিক্রি করে হতদরিদ্র অনেক পরিবারের সংসার চলছে, এটাও তো ভাল সংবাদ।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply