দুসস ডেস্কঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন মো. শহীদুল ইসলাম। কাগজে-কলমে শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে দূতাবাস পরিচালনার দায়িত্বভার এই কূটনীতিকের হলেও দূতাবাস প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম বীথির ইশারায় চলে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি দূতাবাসে শহীদুল ইসলামের অফিসকক্ষের পাশেই তার স্ত্রীর জন্য সাজানো হয়েছে আলাদা আরেকটি অফিসকক্ষ। যাকে ‘দূতাবাসের ভেতরে দূতাবাস’ নাম দিয়েছেন সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রদূত শহীদুলের অফিসকক্ষের পাশাপাশি তার স্ত্রী বীথির অফিসকক্ষেও হাজিরা দিতে হয় বলে তথ্য মিলেছে। যা নিয়মবহির্ভূত জানিয়ে গণমাধ্যমের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দূতাবাসে দায়িত্বরত একাধিক কর্মকর্তা।
অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, শহীদুল ইসলাম রাষ্ট্রদূত হলেও সেখানকার কর্মকর্তারা তার স্ত্রী বীথিকে খুশি রাখতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এ ছাড়া দূতাবাসে কর্মরত অন্য কর্মকর্তাদের স্ত্রীরা স্বামীর যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য বীথির মন জুগিয়ে চলেন। তারা বলছেন, বীথির সুপারিশ ছাড়া কোনো কর্মকর্তারই ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় কাজে কে কোথায় যাবেন, কে যাবেন না সেটাও ঠিক করেন রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী!
এদিকে শুধু দূতাবাসের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপই নয়, জেসমিন ইসলাম বীথি নিয়মবহির্ভূতভাবে দূতাবাসের গাড়ি ও লোকবল ব্যবহারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন বলেও জানিয়েছেন সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুই বছর মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন মো. শহীদুল ইসলাম। এই দায়িত্বে যাওয়ার আগে তিনি বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। শহীদুল ইসলাম অবসরে চলে গেলেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। মূলত সরকার তার ওপর আস্থা স্থাপন করে গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটির সঙ্গে দেনদরবারে সুফল মিলবে এই প্রত্যাশা থেকে। কিন্তু সুফল তো আসেইনি, বরং তার কূটনৈতিক ব্যর্থতায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হয়েছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক। রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামের খামখেয়ালিপনার ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপ দূতাবাস জানা বা জানানোর আগে ঢাকা জেনে যাচ্ছে। তার ওপর আস্থা রেখে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পরও লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে এই কূটনীতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে সেখানে ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ ইমরানকে পাঠানো হচ্ছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি দেশ থেকে আওয়ামী লীগের সংসদীয় প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যায়। তাদের অনেকেই দেশে ফিরে শহীদুল ইসলামের কর্মকাণ্ডে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ওই প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত সবাই রাষ্ট্রদূত ও তার স্ত্রী জেসমিন ইসলাম বীথির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। তবে চাকরির ক্ষতি হওয়ার ভয়ে তাদের কেউই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস দেখান না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ওই সংসদীয় প্রতিনিধিদলের এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি অবাক হয়েছি যে, রাষ্ট্রদূত শহীদুল তার কার্যালয়ের ভেতরেই আরেকটি অফিসকক্ষ কীভাবে স্ত্রীর জন্য রাখেন।’
গত ১ এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর : মতবিনিময় সভা’ শীর্ষক একটি রুদ্ধদ্বার সভা হয়। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয় ওই সভায়। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে মতবিনিময় সভায় রাষ্ট্রদূত শহীদুলের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা হয়। একাধিক আলোচক বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস ওয়াশিংটনে সাফল্য দেখাতে পারছে না। সেখানে দূতাবাসের কাজগুলো বাংলাদেশের হয়ে করছে লবিস্ট ফার্ম। তাহলে দূতাবাসের কাজ কী? রাষ্ট্রদূত শহীদুলকে তো সেখানে আনন্দ ভ্রমণের জন্য পাঠানো হয়নি।
ওয়াশিংটন ডিসিতে রাষ্ট্রদূত স্বামীর দায়িত্বের বেশিরভাগই স্ত্রী বীথি পালন করেন জানিয়ে ওই দূতাবাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নিজের অফিসকক্ষের পাশেই স্ত্রীর জন্যও একটি অফিসকক্ষ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম। সব কর্মকর্তাই রাষ্ট্রদূতের অফিসকক্ষ ও তার স্ত্রী বীথির অফিসকক্ষ দুটোতেই হাজিরা দেন, যা একেবারেই নিয়মবহির্ভূত।’
দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য থাকা দুটি গাড়ির একটি শহীদুল ইসলাম ব্যবহার করেন। অন্য গাড়িটি (যার নাম্বার ডি ডি পি-১২৭৮) তার ডেপুটির ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সেই গাড়িটি শহীদুলের দাপুটে স্ত্রী বীথির সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে। বাসা, অফিস ও ব্যক্তিগত সব কাজেই বীথি ব্যবহার করেন দূতাবাসের গাড়িটি। দূতাবাসের কর্মচারী জসীম উদ্দিনকে জেসমিন ইসলাম বীথির গাড়ির সার্বক্ষণিক চালক হিসেবে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে স্ত্রীকে খুশি রাখতে দূতাবাসের আবুল হোসেন নামে এক কর্মচারীকে বাসার মালীর দায়িত্ব দিয়েছেন শহীদুল ইসলাম।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দাপ্তরিক কাজে কর্মকর্তারা যাতায়াত করেন ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে। আমাদের গাড়ির ভীষণ সংকট থাকলেও রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ রাখা গাড়িটি আর কারও ব্যবহারের সুযোগ নেই। মালী-ড্রাইভার কাজ করে বাসায়, কিন্তু বেতন-ভাতা দেওয়া হয় দূতাবাসের টাকায়।’
রাষ্ট্রদূত শহীদুল ও তার স্ত্রী বীথির নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে দূতাবাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শহীদুল ইসলাম রাষ্ট্রদূত হলেও দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তার স্ত্রী বীথিকে খুশি রাখতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। দূতাবাসে কর্মরত অন্য অফিসারের স্ত্রীরা স্বামীর যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য বীথির মন জুগিয়ে চলতে চান। শুধু তাই নয়, বীথির পরামর্শ ছাড়া কোনো কর্মকর্তারই ওয়াশিংটন ডিসি কার্যালয়ে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতই সর্বেসর্বা। তাই তাকে ও তার স্ত্রীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চান না কেউই। মুখ বুজে সবাই সবকিছু সহ্য করে নেন।’
পদোন্নতি বা সংশ্লিষ্ট অন্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বীথির মূল্যায়নের ওপরই সব নির্ভর করেএমনটা দাবি করে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এসব নির্ভর করে কাজের দক্ষতার ওপর নয়। আর সোশ্যাল ইভেন্টগুলো কাকে দিয়ে করানো হবে বা রাষ্ট্রীয় কাজে কে কোথায় যাবেন, কে যাবেন না সেটাও ঠিক করেন রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী। রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কোন কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকবেন, তাও ঠিক করেন তার ক্ষমতাধর স্ত্রী বীথি। ক্ষমতার দাপটে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর পছন্দের তালিকায় থাকতে অন্য কর্মকর্তার স্ত্রীরাও সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তাকে নিয়ে। ওইসব কর্মকর্তার স্ত্রীরা বীথির মন জোগাতে হেন কোনো কাজ নেই যা তারা করেন না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ না করে ব্যস্ত আছেন জানিয়ে বার্তা পাঠান। পরে গণমাধ্যমের পরিচয় দিলে ও কল করার কারণ জানিয়ে বার্তা পাঠানোর পর তাকে আবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পরে রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি বর্তমানে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply