নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আনোয়ার হোসেন। পদ্মাসেতু চালুর সাথে সৌভাগ্যের দ্বার সাজিয়ে হাজির হচ্ছে বেনাপোল স্থল বন্দর বাসীর জন্যে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে শংকায় দীর্ঘদিনের অচল সময় নিয়ে ব্যবসায়ীদের যেমন রয়েছে বিস্তর অভিযোগ, পাশাপাশি রয়েছে উন্নয়নের নানা উদ্যোগ। পদ্মাসেতু প্রকল্প শুরু হওয়ার পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে এসব উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করার কথা জানালেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
পদ্মাসেতু চালুর পর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও পাসপোর্ট যাত্রীদের যে বাড়তি সুযোগ তৈরি হবে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা বেনাপোল স্থলবন্দরে আছে কি না সে বিষয়ে জানতে এসময় কথা হয় কাস্টমস, স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের নেতাসহ অন্যান্যদের সাথে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ভারত পদ্মা সেতু তাদের জন্য সৌভাগ্য হিসেবে দাবি করলেও অভিযোগ করেছেন, ‘পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে হয়তো আমাদেরকে সামনে অনেক সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে’। তিনি বলেন, জায়গা সংকটের কারণে আমদানিকৃত মালা মাল লোড-আনলোড করতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। রয়েছে উপকরণেরও অভাব। বিশেষ করে ক্রেন/ফরক্লিপের যথেষ্ট অভাব আছে’।
আমদানিকারক ফিরোজ আলম ও ফারুক আহম্মেদ অভিযোগে বলেন । তাদের দাবি, ‘যারা এই পোর্ট দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করি তারা বর্তমানে খুবই নির্যাতিত, অবহেলিত। বর্তমানে ভারত থেকে এক ট্রাক পণ্য দেশে ঢুকতে এক মাসেরও অধিক সময় লাগছে। এক কনসাইনমেন্ট পণ্য ভারত থেকে বেনাপোল স্হল বন্দর দিয়ে আমদানি করায় ওপারে ভারতে আমদানিকারকদের একমাসে অতিরিক্ত গুণতে হয় ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার রুপি। বাড়তি এই খরচ পরবর্তীতে পণ্যের ওপর পড়ে ভোক্তার কাঁধে চাপে’ বাড়তিখরচ।
বন্দর ব্যবহারকারীদের দাবি, পদ্মাসেতু চালুর সাথে সাথে চাপ বাড়বে বেনাপোল স্হল বন্দরে। কিন্তু, সেই চাপ কে সামাল দিতে না পারলে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। সে কারণে অবকাঠামো গত উন্নয়ন সহ নানা সুপারিশ করেছেন তারা। তবে, বসে নেই স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষও। সকল সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বেনাপোল কে সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের স্থল বন্দর তৈরি করতে হাতে নেয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। এর মধ্যে তিনশত’ ৫৬ কোটি টাকার তিনটি প্রকল্পও পরিচালনা করা হচ্ছে। যা সম্পন্ন হতে সময় লাগবে প্রাই দুই বছর। তখন পাল্টে যাবে বেনাপোল স্হল বন্দরের দৃশ্যপট। অবসান হবে সকল সমস্যা। যার সুফল ভোগ করবেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে যুক্ত পাসপোর্ট যাত্রীরা।
‘বেনপোল স্হলবন্দরে জায়গা সংকটের কারণে এক ট্রাক পণ্য আনলোড হতে সময় লাগে সাত থেকে দশদিন। ট্রাকগুলো এক শেড থেকে আর এক শেডে ঘুরে বেড়াতে হয়। মনে হয় যেনো এগুলো বেওয়ারিশ। এই শেড ইনচার্জ বলে জায়গা নেই, ওই শেড ইনচার্জ বলে জায়গা নেই। এতে দীর্ঘদিন ট্রাকে থাকার কারণে মালের গুনগত মানও নষ্ট হচ্ছে’। তিনি মনে করেন, দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে পদ্মাসেতুর প্রভাবে যে চাপ বেনাপোল বন্দরে তৈরি হবে তা মিটিয়ে পরিপূর্ণ সুফল ঘরে তোলা দূরূহ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ভারত চেম্বারের ডাইরেক্টর মতিয়ার রহমান বলেছেন, সোনামসজিদ বা বাংলাবন্ধে যেসব পণ্য চালান আসে সেগুলোকে অনেক ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অন্যদিকে, বেনাপোল হলো ভারতের কোলকাতায় প্রবেশদ্বার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। সে কারণে ব্যবসায়ীরা চাইবেন বেনাপোল দিয়ে অধিক পণ্য পাঠাতে। কিন্তু, বেনাপোলে অবকাঠামো বলতে কিছু নেই। এর আমূল উন্নতি ছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়া যাবেনা বলে মনে করেন মতিয়ার রহমান।
বেনাপোল আমদানি ও রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহসিন মিলন বলেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেনাপোল স্হল বন্দরে ঘটেনি। প্রতিদিন এক হাজার ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করার সুযোগ থাকলেও স্থান সংকটের কারণে আসে মাত্র দুই থেকে তিনশত’ ট্রাক।
সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশন পদ্মাসেতুর সুফল যদি আনতে হয় স্হলবন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে, সিসিটিভি ক্যামেরা কার্যকর করতে হবে, যানজট দূর করতে হবে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বন্দরে ক্রেন/ফরক্লিপ পুরাতন বাদ দিয়ে বাড়াতে হবে নতুন । জনবল দ্বিগুণ করতে হব।
বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ কিছুটা সঠিক বলে মনে করেন কাস্টমস কমিশনার আজিজুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘বন্দরের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বন্দরে এখন ক্ষমতা আছে বছরে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা। কিন্তু, বছরে এক লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পণ্য লোড-আনলোড হচ্ছে। এখানে নতুন নতুন কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে’।
তিনি বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ দুই-তিনটা প্রকল্প দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং অবশ্যই শেড বাড়াতে হবে, এটার বিকল্প নেই। আমদানিকারক-রপ্তানিকারকদের দাবিকে মাথায় রেখে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এটাকে সম্প্রসারিত করবে বলে আমার বিশ্বাস’।
বন্দরের সমস্যার পাশাপাশি কাস্টমসেরও কিছু প্রস্ততির কথা জানান কমিশনার। তিনি বলেন, ‘ডিম্যান্ড ক্রিয়েট হওয়ার সাথে সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। কাস্টমস হাউজ এখন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে যদি আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পায় তাহলে সেইভাবে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী আরও বেশি সংখ্যক নিয়োগ দিতে হবে। সেটা পূরণ করা সম্ভব। সেইভাবেই আমরা কার্যক্রম সম্পন্ন করবো’।
এদিকে, পদ্মাসেতু চালুর সাথে সাথেই বেনাপোল বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজও এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করেছেন বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার। ‘বন্দরে তিনশ’ ৫৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এই প্রকল্প শেষ হলেই বন্দরের স্থান সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের নিরাপত্তা বাড়বে এবং পণ্যের গুণগত মানও অক্ষুন্ন থাকবে’-বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে পরিবহনের চাহিদাও বাড়বে। এটি মাথায় রেখে আমরা ২৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছি। পরে আরও সাড়ে ১৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ হয়েছে। আরও একশত’ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
মামুন কবীর তরফদার বলেন, দুইশত’ ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জিরো পয়েন্টের পাশে ২৫ একর জমিতে নির্মাণ হচ্ছে কার্গো ভেইকেল টার্মিনাল। এই কাজ শেষ হবে আগামী বছরের মধ্যে। এই টার্মিনালে একসাথে তিনশ’ পণ্যবাহী ট্রাক অবস্থান নিতে পারবে। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকগুলোই এই টার্মিনালে অবস্থান করবে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না। এতে একদিকে যেমন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য আনলোড করা যাবে তেমনি বাংলাদেশ অংশে যানজট দূর হবে।
এর পাশাপাশি ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ১৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বাউন্ডারি ওয়াল। এই ওয়ালের ভেতরে যে কেউ উচ্ছা করলে প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ অটোমেশন সিস্টেমের আওতায় এর এক্সেস কন্ট্রোল থাকবে কর্তৃপক্ষের হাতে। এই ওয়ালের দৈর্ঘ্য সাড়ে পাঁচ হাজার রানিং মিটার। বন্দরের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ ও চুরি রোধসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প শেষ হলেই পাল্টে যাবে বন্দরের সার্বিক চিত্র।
এছাড়া, সার্বিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পুরো বন্দরকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসার প্রকল্পও প্রায় সমাপ্তির পথে বলে জানান মামুন কবীর তরফদার।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply