নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আনোয়ার হোসেন। শেষ হয়ে আসছে প্রতীক্ষার দিন। মাত্র ৬ দিন পর আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু তৈরির আগে করা সমীক্ষার হিসাব বলছে, দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
ঢাকার সঙ্গে সহজ যাতায়াত প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ। গতি পাবে নগরায়ণ। কৃষিতে আসবে নতুন বিপ্লব। বাড়বে কর্মসংস্থান। বিকশিত হবে পর্যটন। পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটির বেশি মানুষ। সেই সুবিধাভোগীর আওতায় রয়েছেন যশোরের জনগণ।
পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা বয়ে আনছে বলে মন্তব্য করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমি যদি শুধু আমার নিজের কথা বলি পদ্মা সেতু চালু হলে যশোর থেকে আমি ৩ থেকে ৩ ঘণ্টা ৩০মিঃ ঢাকায় যেতে পারব। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায় মানুষের যোগাযোগ কতটা সহজ হতে চলেছে। এ সহজ যোগাযোগের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, পর্যটনসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। সবকিছু মিলিয়ে এমন একটা পর্যায় আসবে যেটা ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ তৈরি করবে এবং অবশ্যই দেশের জিডিপি একটা বড় অংশে বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এ পদ্মা সেতু আমাদের মধ্যে নতুন আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে।
যশোর জেলার উৎপাদন হওয়া সবজি, মাছ ও ফুল সহজে পৌঁছাবে রাজধানী ঢাকাতে। দাম বেশি পাবেন চাষি। এছাড়া বাস ও ট্রেনযোগে যাত্রী পারাপারেও কমে আসবে দূরত্ব। বেনাপোল থেকে আমদানিকৃত পণ্য ট্রাকযোগে দ্রুত যেতে পারবে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুর রহিম জানান, যশোরের গদখালির ফুল বছরে আবাদ হয় ১২শ হেক্টর। ৪শ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে এখানে। যশোর থেকে গাড়িতে ফুল পাঠালে ঘাটে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। এতে ফুলের সজিবতা থাকে না, যেকারণে দাম কম পেতাম। পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি গেলে সময় আড়াই ঘণ্টা কমবে। তখন সহজেই আমাদের ফুল ঢাকার বাজারে যেতে পারবে। ফুল টাটকা থাকলে দাম বেশি মিলবে। এতে আশা করছি এখানকার চাষিরা লাভবান হবেন।
সাতমাইল এলাকার সবজি চাষি আঃ বারিক বলেন, আমাদের এখান থেকে ট্রাকযোগে সবজি ঢাকায় যায়। ঘাটে জাম থাকলে ট্রাকটি পৌঁছাতে দেরি হয়। তখন সবজি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি গেলে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা সময় বাঁচবে। তখন তাজা সবজি ঢাকাতে যেতে পারবে। আশা করছি সবজির চাহিদাও বেড়ে যাবে।
যশোর হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, ঢাকায় যেতে দীর্ঘ সময়ের কারণে প্রচ- গরমে গাড়িতে অনেক পোনা মারা যায়। কিন্তু পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি গেলে সময় কমবে। এতে আমাদের ঝুঁকিও কমে আসবে। আশা করি পদ্মা সেতুর সুফল যশোরবাসী পাবেন।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিইবি) সাবেক সভাপতি ও কলাম লেখক এমআর খায়রুল উমাম বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে খুলনা-বাগেরহাট জেলার মানুষ বেশি সুফল পাবেন। তবে যশোরবাসীও পাবেন। যশোর থেকে ঢাকায় বাসে প্রায় একশ কিলোমিটার ও ট্রেনে ৩শ কিলোমিটার রাস্তা কম হবে। এতে সহজেই যশোরের সবজি, ফুলসহ অন্যান্য পণ্য দ্রুত রাজধানীতে পৌঁছাবে। এছাড়া যশোর-নড়াইল অঞ্চলে গড়ে উঠবে শিল্পাঞ্চল। তখন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি গতি পাবে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এব্যাপারে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে যশোরে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে। জেলাটিতে সব ধরণের উৎপাদিত পণ্যে সহজে ঢাকাতে পৌঁছাবে। তখন পণ্যবাহী গাড়ি দ্রুত পৌছাবে প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া যশোরে গড়ে উঠছে ইপিজেড। তখন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্যও সহজে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায় যেতে পারবে। এছাড়া একজন মানুষ ঢাকাতে কাজ শেষে দিনের দিন ফিরে আসতে পারবে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের অধ্যক্ষ অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক মর্জিনা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে অবশ্যই যশোরের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। গড়ে উঠবে শিল্প প্রতিষ্ঠান। জেলাটির সবজি, ফুলসহ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্য কম সময়ে রাজধানীতে গেলে এখানকার চাষিরা উপকৃত হবেন।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার মো. আজিজুর রহমান জানান, ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে গাড়িগুলো দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে ঢাকায় যেত। তীব্র জটে পড়ে ২-৩ দিন সময় লাগত গন্তব্যে পৌঁছাতে। কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি গেলে দিনের দিন পণ্য পৌছাতে পারবে। আশা করছি এতে করে বেনাপোল কাস্টমস ও বন্দরের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাব।
পদ্মা সেতু তৈরির আগে করা সমীক্ষায় বলা হয়, পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফল ভোগ ভোগ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। সেতুর জন্য করা নদীশাসন কাজ এ অঞ্চলে পদ্মার ভাঙন প্রবণতা কমাতে ভূমিকা রাখবে। কর্মসংস্থান, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্য কমবে। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু।
সমীক্ষায় আরো বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের জাতীয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। মানুষের আয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্য সংযোজন করবে। ৭ লাখ ৪৩ হাজার ‘ম্যান-ইয়ার’ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তবে এসব প্রভাব পড়তে নির্মাণ-পরবর্তী চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে। আর পদ্মা করিডরে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ চালু হলে আরো গতিশীল হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও টেলিকম পরিষেবার লাইন সংযোগ গড়ে তোলা হয়েছে। এসব পরিষেবা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানার বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে সহজ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবাদে আরো গতিশীল হয়ে উঠবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে এ দুই বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্য বড় শহরে পৌঁছে যাবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply