নিজস্ব প্রতিবেদকঃ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল যশোরের মানুষের চিকিৎসা সেবার প্রধান সরকারি প্রতিষ্ঠান এ হাসপাতালটির জরুরী বিভাগে ২০ টাকার টিকিটে সেবার পর রোগীকে ওয়ার্ডে নিতে বিনা রশিদে স্বজনদের গুনতে হয় ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এসব টাকা যায় হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবীদের পকেটে। ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেতন দেয় না’ এই অজুহাতে রমরমা ট্রলি ও হুইল চেয়ার ভাড়া বাণিজ্যে মেতে উঠেছে তারা। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, অতিরিক্ত রোগীর চাপ এবং জনবল সংকটের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের হাসপাতালের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ তলার ওয়ার্ডে স্থানান্তরের জন্য জরুরী বিভাগে রয়েছে একাধিক ট্রেচার এবং হুইল চেয়ার। যে সেকল রোগী হাঁটতে পারবে না; তাদের প্রয়োজনে জরুরী বিভাগে এগুলো থাকে। তবে এ সকল হুইল চেয়ার বা ট্রেচার গুলোও থাকে জরুরী বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘোরাঘুরি করা স্বেচ্ছাসেবীদের দখলে।
রোগীদের ট্রেচার বা হুইল চেয়ারে করে উপরের তলায় উঠাতে গেলে তাদের সাথে করে নিতে হয় অর্থচুক্তিতে। অন্যথায় রোগী ট্রেচার ঠেলে উপরে উঠানোর কাজ করা লাগবে রোগীর স্বজনদের। তবে সেক্ষেত্রেও আগে টাকা দিয়ে ট্রলি নিতে হবে। আবার কখনো কখনো স্বেচ্ছাসেবীরা রোগী ট্রেচার বা হুইল চেয়ারে করে ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়ার পর ৫০ থেকে ৩০০ টাকা স্বজনদের কাছে পারিশ্রমিক বা বকশিস হিসেবে দাবি করে। এ নিয়ে শুরু হয় প্রায়ই ঝকড়া ঝাটি হাতা হাতির খবর শোনা যায়। এখানেই শেষ নয়, হাসপাতালের শয্যার চাদর পাল্টানো, ক্যানোলা পরানো বা খোলা, ক্যাথিটার পরানো বা পরিবর্তন করার কাজেও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। এ সব প্রকাশ্যে দেখেও কোন প্রতিবাদ করেন না ডিউটিরত সেবিকা বা চিকিৎসকেরা।
মঙ্গলবার পরিচয় গোপন রেখে জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তি হওয়া এক নারী রোগীর পিছু নেয় প্রতিবেদক। দেখা যায়, জরুরি বিভাগ থেকে এক যুবক ওই রোগীকে ট্রেচারে উঠিয়ে তৃতীয় তলায় নিয়ে যায়। এরপর মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের ভেতরে জায়গা না থাকায় ওয়ার্ডের বাহিরে মেঝেতে শুইয়ে দেয় ট্রলি ঠেলা ওই যুবক। প্রতিবেদকের দেখে রোগীর স্বজনকে নিয়ে ওয়ার্ডের ভেতরে আড়াল করে ৫০ টাকা দাবি করে। এ সময় ওই নারী রোগীর স্বামী বাঘারপাড়ার সুদেব মন্ডল ৩০ টাকা দিতে চাইলে ওই যুবক নিতে নারাজ। এ সময় প্রতিবেদক ওই যুবকের নিকট একাধিকবার নাম জিজ্ঞাসা করলেও একপর্যায়ে সেন্ট্রাল রোডের বিজয় (২৩) নাম বলে সটকে পড়ার চেষ্টা করেন। টাকা নেয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বিজয় বলেন, আমাদের কোন বেতন দেয় না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে জরুরি বিভাগের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে আরেক ব্যক্তিকে দেখা যায়, হুইল চেয়ার নিয়ে চতুর্থ তলা থেকে রোগী নিচে নামানোর বিষয়ে দরাদরি করতে। প্রতিবেদকের সামনে তিনি রোগী নামাতে প্রকাশ্যে ২০০ টাকা দাবি করেন এবং নামানো উঠানো করতে হলে ৩০০ টাকা দেওয়া লাগবে। এ সময় ওই ব্যক্তির নিকট নাম জানতে চাইলে তিনিও পরিচয় দিতে রাজি হননি।
রোগী পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে নিচে নামাবার জন্য মরিয়া হয়ে ট্রলি, হুইলচেয়ার খুঁজছিলেন যশোর সদরের সাতমাইল এলাকার আফজাল হোসেন। তার কাছেও ট্রেচারে করে রোগী নামাতে চাওয়া হয়েছে ১৫০ টাকা। অন্যথায় নাকি ট্রেচার দেওয়া যাবে না।
কিছুক্ষণ পরে আফজাল হোসেনকে দেখা যায়, তার এক স্বজনকে সাথে নিয়ে নিচ থেকে একটি ট্রলি ঠেলে উপরের তলায় উঠাতে। প্রশ্ন উত্তরে আফজাল হোসেন বলেন, তিন তলা থেকে আমার রোগীটা নামাবো পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। আমার কাছে ট্রলির ভাড়া চেয়েছে ১৫০ টাকা। নিচে গিয়ে আমরা ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসলাম; তাও ১০০ টাকা দিয়ে আসতে হয়েছে। আমরা ভালো চিকিৎসার জন্য এখানে আসি। আর এখানে এসে যদি রোগী বহন করতেই ২০০-৩০০ টাকা গোনা লাগে তাহলে যাবো কোথায় ?
এদিকে ট্রলি না পেয়ে তৃতীয় তলায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ইমতিয়াজ নামের এক ব্যক্তিকে বেশ উত্তেজিত হতে দেখা যায়। জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, সকাল থেকে তার রোগীদের দুইবার উঠা নামার জন্য ট্রলি ভাড়া দেওয়া লেগেছে ২০০ করে মোট ৪০০ টাকা। পুনরায় ট্রলি চাইলে ওয়ার্ডবয় টাকা চাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, জরুরি বিভাগের মধ্যে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী ওত পেতে থাকেন ভর্তি রোগীর জন্য। তাদের প্রত্যেকের দখলে থাকে একটি করে হুইল চেয়ার অথবা ট্রেচার। কখনো কখনো তাদের কাছে আইডি কার্ডও দেখা যায়। তবে তাদের ট্টলি বাবদ টাকা নেওয়ার বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তারা বলেন, হাসপাতাল থেকে তারা কোন বেতন পান না। তবে তাদের প্রত্যেকের ট্রলি, হুইলচেয়ার ঠেলে দৈনিক আয় এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আয়করে থাকেন।
এ সকল বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, স্বেচ্ছাসেবকদের বেতন দেয়া হয় না এটা সত্য। হাসপাতালের ট্রলি, হুইল চেয়ারে রোগী বহনের জন্য ২৬ জন ওয়ার্ডবয় রয়েছে। তারা রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি করেন এবং স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন ৯৯ জন। ২৫০ শয্যা হাসপাতালে বর্তমানে ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। জনবল সংকটের কারণে রোগীর স্বজনরাও স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতা নেয়। হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল সংকটের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও জানানো হয়েছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply