১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, যারা এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এবং দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলো, তারাই বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে। রাতারাতি এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে ঘাতকচক্র এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা শুরু করে।
জেলহত্যা দিবস স্মরণে আজ শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে ‘৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবসের অঙ্গিকার: রুখতে হবে বিএনপি-জামায়াত-রাজাকার’ শীর্ষক আয়োজিত আলোচনা সভায় তারা এসব কথা বলেন। এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’।
পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ এডভোকেট দিদার আলী, সাবেক কারা মহাপরিদর্শক লিয়াকত আলী খান, তথ্যচিত্র নির্মাতা ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহত কর্ণেল জামিলের মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা, বিশিষ্ট চাটার্ড একাউন্টেন্ট শাহাদাত হোসেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য পারভেজ জামান, বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রয়াত সভাপতি ডা. এস এ মালেক এর কন্যা নাদিরা রহমত উল্লাহ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ডুয়েট উপাচার্য ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে সুস্থ্য ধারার রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ওপর হয়তো অনেকের রাগ ছিলো, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাহলে জেলখানায় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হলো? আসলে যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে না, তারাই বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে হত্যা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া। দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা জীবন দিয়ে গেছেন। তাদের আদর্শকে ধারন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে একটি জাতীয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির কথা আমরা দীর্ঘদিন দাবি করে আসছি। এর জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটা কমিশন করা প্রয়োজন। এই কমিশন আইনগতভাবে সংসদের মাধ্যমে করা যেতে পারে। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে সব ধরনের নথি দেখার অনুমতি দিলে নতুন নতুন ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। জাতি নতুন ইতিহাসের খোঁজ পাবে।
লিয়াকত আলী খান জেল হত্যার ঘটনার বিবরণ দেন।
ফুয়াদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্যাটার্নটা এমন যে অল্প কিছু মানুষ জানতেন যে, তাদের হত্যা করা হবে। বাকিরা জানতেন না যে, তাদের হত্যা করা হবে। তারা জানতেন বঙ্গবন্ধুকে ধরে রেডিও স্টেশনে নেওয়া হবে। সেই অল্প কয়েকজন খুনিরাই জেলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জিয়াউর রহমানের সহায়তায় পালিয়ে গিয়েছিলো।
আফরোজা জামিল কঙ্কা বলেন, রাজনৈতিকভাবে আমাদের এতিম বলা চলে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাদেরই হত্যা করা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে বাঙ্গালি সংস্কৃতির থেকে বিমুখ করে তোলা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের ফলে সকল দলেরই মানুষ সুবিধা ভোগ করেছে কিন্তু রাজনীতির নামে বিরোধী দল শেখ হাসিনার অপপ্রচার করে চলছে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা রাতারাতি করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই এই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে জাতিসংঘে মুজিবনগর সরকারের পর্যবেক্ষক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও খন্দকার মোশতাককে সেই দলের নেতা হিসেবে পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয় আবদুস সামাদ আজাদকে। কারণ তখন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিলো যে, খন্দকার মোশতাক জাতিসংঘে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও খন্দকার মোশতাক মিলে পাকিস্তান কনফেডারেশন হয়ে গেলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ভেস্তে যেতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে গিয়েছিলেন আর তাজউদ্দিন আহমেদের কাজ ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করা। কেননা তখন যুদ্ধের কোনো বিকল্প ছিলো না। তাই খন্দকার মোশতাককে সেই প্রতিনিধি দলে পাঠানো হয়নি।
তিনি বলেন, অল্প কয়েকজন মিলে বঙ্গবন্ধু এবং জেল হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব হতো না যদি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাদের প্রতিহত করা হতো। ঘাতকরা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে নিরাপদে দেশের বাইরে চলে যেতে পারতো না। সবাই যদি তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতেন, তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না।
তিনি আরো বলেন, একজন বাঙালি অ্যামেরিকান সিটিজেন বিএনপির কার্যালয়ে এসে নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেন। যদি মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা আসেন, তাহলে তার সংবাদ সম্মেলন হওয়ার কথা মার্কিন দূতাবাসে, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে নয়। সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টার পাশে বিএনপির কয়েকজন চেনা-অচেনা নেতা ছিলেন।
বাইডেনের উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন করলে তার পাশে কার থাকার কথা? নিশ্চয়ই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের থাকার কথা। এই যে সহজ একটা বিষয়। কিন্তু কী ধরনের প্রতারণার চেষ্টা করা হয়েছে। এই প্রতারণাটা কি একদিনে হয়েছে? না। এর পেছনেও অনেক দিনের ষড়যন্ত্র রয়েছে। এই ষড়যন্ত্রকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন জেলা ও থানা কমিটির নেতৃবৃন্দ।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply