পরিবহন সেক্টরে চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর পর থেকেই পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন করা হচ্ছে। সব পরিবহন কমিটির নেতৃত্ব নিতে রীতিমতো মরিয়া বিএনপিপন্থি নেতারা। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে একাধিক গ্রুপও হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়।
এরই মধ্যে ২০০১ সালের বিএনপিপন্থি পরিবহন নেতারা দখলে নিয়েছেন বাস মালিকদের রাজধানী এবং সারা দেশের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয়। পুরোনো কমিটি বহাল থাকা অবস্থায় বাস মালিকদের নতুন ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে গত ১৪ আগস্ট। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখল হয়ে গেছে। বিগত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ রাতারাতি ভোল পাল্টে বিএনপিপন্থি পরিবহন নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহনের নেতৃত্ব। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুর, খুলনায় নেতৃত্ব ঠিক করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
রাতারাতি রাজধানীর পাঁচ শতাধিক পরিবহন কোম্পানির পরিচালনায় গঠন করা মালিক সমিতির ৪০০-এর বেশি বদলে ফেলা হয়েছে। তবে পলাতক রয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। যে কোনো সময় শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয় দখল হতে পারে বলেও জানা গেছে। পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিত বর্তমান ও সাবেক নেতাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চলা এনা পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রায় ৩০টির বেশি জেলায় এ কোম্পানিটি বাস পরিচালনা করে। যাদের তিন হাজারের বেশি স্টাফ ও দুই হাজারের বেশি বাস রয়েছে। ঢাকা সড়ক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ছিলেন এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেই এনা কোম্পানির সব রুটের বাস বন্ধের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তেমনি বাস থেকে কোম্পানির নাম মুছে দিয়ে ভিন্ন নামে চালানোর চেষ্টা চলছে বলেও জানা গেছে।
পরিবহন নেতারা জানান, সারা দেশে বাস মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি ছিলেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা ও মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। ঢাকা সড়কের সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম, মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। এ দুই সংগঠন রাজধানীর সব পরিবহন কোম্পানি থেকে শুরু করে নগরীর সবকটি টার্মিনাল এমনকি দেশের বেশিরভাগ পরিবহন ব্যবসা ও কমিটি নিয়ন্ত্রণ করত। ৫ আগস্টের পর থেকে মসিউর রহমান রাঙ্গার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তিনি দেশে আছেন নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউ বলতে পারে না। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। এ সুযোগে রাজধানীর ইস্কাটনে ঢাকা সড়ক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যালয় দখল হয় বিএনপিপন্থি পরিবহন নেতা সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে। তিনি বিএনপির দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি কেন্দ্রীয় বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে। ইলিয়টগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে একটি বাস কোম্পানিরও মালিক তিনি। তার সঙ্গে আছেন সাবেক কার্যকরী সভাপতি আবদুল বাতেন, বাবুল, মন্টু ও মামুন।
পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, ১৪ আগস্ট সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া ঢাকার বিভিন্ন বাস কোম্পানির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে আহ্বায়ক করে ৩১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করবে।
বৈঠকে থাকা একাধিক বাস মালিক সমিতির নেতা জানিয়েছেন, নতুন কমিটি ঢাকা মহানগরসহ শহরতলির বাস মালিকদের নতুন সব কমিটি অনুমোদন দেবে। রুট কমিটি আওয়ামীপন্থি অনেক নেতাই এখন পলাতক। এই সুযোগে কোনোটি দখল হয়েছে। সব মিলিয়ে রুট কমিটিগুলোতে অস্থিরতার কারণে রাজধানীতে বাস চলাচল এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ১০ ভাগের এক ভাগ বাস প্রতিদিন চলার কথা জানিয়েছেন মালিক সমিতির নেতারা।
এরই মধ্যে তুরাগ, রাইদা, লাভলী, শিকড়, ভিক্টর ক্ল্যাসিক, অনাবিল, প্রজাপতি, আট নম্বর, বনানী ট্রান্সপোর্ট, গাজীপুর পরিবহন, বলাকা, লাব্বাইক, মালঞ্চ, তরঙ্গ, আলিফ, অভিনন্দন, বিকাল, মেঘলা, ভিআইপি পরিবহন, মিডলাইন, রমজান, স্বপ্ন, ভূঁইয়া, স্বাধীন, দেওয়ান, গাবতলী পরিবহনসহ চার শতাধিক বাস কোম্পানির মালিক সমিতিতে পরিবর্তন এসেছে। এতে দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপিপন্থি পরিবহন সেক্টরের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। কিছু কমিটিতে আওয়ামী লীগের সময় দায়িত্ব পালন করা নেতাদেরও রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বলাকা পরিবহনের নতুন দায়িত্ব নেওয়া মালিক সমিতির নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন সরদার জানান, অনেক রুটে কমিটি পরিচালনা করার লোক নেই। তাহলে মালিক ও শ্রমিকদের সমস্যা দেখবে কারা। কোম্পানি তো অভিভাবক ছাড়া চলতে পারে না। তাই সবার চাওয়া থেকে আমি নতুন করে দায়িত্ব নিয়েছি। সদরঘাট থেকে আব্দুল্লাহপুর রুটে চলা ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনের দায়িত্ব নিয়েছেন বাড্ডা এলাকার বিএনপি নেতা শাহীন।
সূত্র জানায়, বিএনপি আমলের পরিবহন নেতা জাহিদ আল লতিফ খোকা গত বৃহস্পতিবার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল মালিক সমিতি কার্যালয়ে অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি হিসেবে সবুর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে তারা পলাতক আছেন। মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। এই সুযোগে দখল হয়েছে টার্মিনাল মালিক সমিতি কার্যালয়।
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন আবুল কালাম। অভিযোগ উঠেছে, তিনি সরকার পরিবর্তনের পর ভোল পাল্টে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এই কমিটির সভাপতি পদে এখনো পরিবর্তন না এলেও অন্যান্য পদে আসছে। দখলের অপেক্ষায় গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল মালিক সমিতি কার্যালয়।
মহাখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, আমাদের সমিতি দখল হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে।
সায়েদাবাদ টার্মিনালে থাকা ঢাকা মহানগর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয় রহিম মুন্সি নামে একজন বিএনপিপন্থি শ্রমিক নেতা দখলে নিয়েছেন। এরই মধ্যে কার্যালয়ে ভাঙচুরসহ পুরোনো কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী শোভা ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম সরওয়ার। পাঁচ আগস্টের পর থেকে তারাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
সারা দেশের পরিবহনে নানা নামে গঠিত শ্রমিক ইউনিয়নগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। যার সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী শাহাজান খান ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ওসমান আলী। ৫ আগস্টের পর থেকে দিলকুশার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। শাহাজান খানের মোবাইলও বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, আমাদের কার্যালয় এখনো দখল হয়নি। যে কোনো সময় হতে পারে। ভয়ে আছি। তিনি বলেন, সায়েদাবাদ, গাবতলী, ফুলবাড়িয়া, জামালপুর, রাজশাহীসহ ১০টির বেশি জেলায় শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয় দখল হয়েছে। আগামীকাল (সোমবার) ফেডারেশনের কার্যালয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
সূত্র বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয় দখল করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে গাবতলী পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখল হয়েছে। মহাখালীও যে কোনো সময় দখল হতে পারে।
পরিবহন মালিক সমিতির শীর্ষ নেতার বাস কোম্পানি ‘এনা পরিবহন’। এই কোম্পানির সবচেয়ে বেশি বাস পরিচালনা করা হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে। ৫ আগস্টের পর থেকে বন্ধ রয়েছে এনার ঢাকা ময়মনসিংহ রুটে বাস চলাচল। এতে ভোগান্তি বেড়েছে এই রুটের যাত্রীদের।
কোম্পানির একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, ময়মনসিংহ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছানু মিয়া জেলার মাসকান্দা টার্মিনালে এনা কাউন্টারে গিয়ে বলেছেন, বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এনা পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ থাকবে। এরপর এই রুটের সব বাস ঢাকায় এনে রাখা হয়েছে। অন্যান্য জেলায় সীমিত পরিসরে এই কোম্পানির বাস চলছে।
জানা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনা পরিবহনের অন্যতম শেয়ার ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল হক শামীম। যিনি শামীম পরিবহনের মালিক। অভিযোগ আছে, তিনি খন্দকার এনায়েত উল্যাহর বাস আলাদা করে কোম্পানির নাম বদলে অন্য নামে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছেন। সব বাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে এনার নাম। বক্তব্য জানতে আমিনুল হক শামীমের মোবাইল ফোনে চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তারও সাড়া দেননি তিনি। তবে এনা কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন কোম্পানিতে তাদের বাস পরিচালনা করলে আপত্তি নেই। এতে নিয়মিত লোনের কিস্তি পরিশোধে সহায়ক হবে। তেমনি তিন হাজার শ্রমিককে পথে বসতে হবে না।
ময়মনসিংহ জেলা মোটর মালিক সমিতির মহাসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, খন্দকার এনায়েত উল্যাহর এনা ছাড়া অন্য মালিকদের বাস চলছে। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালামেরও দাবি এনা পরিবহন চলছে। সরেজমিন দেখা যায়, এনা কাউন্টার বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সমিতির গঠনতন্ত্র অনুসরণ না করে আরেকটি কমিটি অবৈধভাবে গঠন করা হয়েছে, যা আইনসিদ্ধ নয়।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নতুন কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, সারা দেশে নতুন কমিটি করতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করছি। গত ১৪ আগস্ট ঢাকা সড়কের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। আগামী রোববার থেকে নতুন কমিটি অফিস করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোনো কমিটি অগঠনতান্ত্রিকভাবে দখল করিনি। গঠনতন্ত্র মেনে তলবি সভা করে সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে পুরোনো কমিটি বাতিল করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। মূলত সড়ক পরিবহন সেক্টর অরক্ষিত ছিল। আমরা দায়িত্ব নিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি।
পরিবহনের একাধিক নেতা জানান, বিএনপি আমলে গোটা পরিবহন সেক্টরে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ মিয়ার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি জেলে যাওয়ার পর কোম্পানির দায়িত্ব নেন তার ভাই কফিল উদ্দিন। তিনি বিএনপির পক্ষে সাভার উপজেলার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিবহনের নতুন পরিবর্তনের নেপথ্যে হানিফ পরিবহনের দুই ভাইসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই শীর্ষ নেতা রয়েছেন বলে জানা গেছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply