নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ব্যাংক ঋণের সুদ গণনায় ‘কম্পাউন্ড রেট’ বা চক্রবৃদ্ধি হার আর থাকছে না। সরল সুদহার ও সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর হচ্ছে। এতে বিদ্যমান খেলাপি ঋণ যেমন কমবে, তেমনি শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে। কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সরকার যুগোপযোগী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা কার্যকর করতে রবিবার ব্যাংক পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত সর্বশেষ সার্কুলার প্রসঙ্গে বলেছেন , ‘আমরা ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ হিসেব নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে না যায়। কাউকে ঋণের টাকা মাফ করতে বলিনি। বরং ঋণ পরিশোধে সময় দিয়েছি।’ তিনি বলেছেন , ‘আমি বলেছিলাম ঋণখেলাপি বাড়বে না, বরং সামনে ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণের হার কমবে। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে এটা সত্য। কিন্তু কেন বাড়ল, সেটা আমাদের জানা দরকার। এর মূল কারণ সুদের হার। সুদের হার বাড়লে খেলাপি ঋণ বাড়বেই। সুদের হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হলে এটা দিয়ে ঋণগ্রহীতারা কুলাতে পারে না। তাই সুদের হার ৯ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি এবং আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। সুদের হার ৯ শতাংশ হলে এনপিএল বাড়বে না। আশা করা যায়, ১০ বছর পরে আমাদের ব্যালেন্সসিটও পরিষ্কার হয়ে যাব
অর্থমন্ত্রী বলেছেন , ‘আমাদের দেশের উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। এগুলো সম্ভব হওয়ার পেছনে আমাদের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বড়ো অবদান রয়েছে।’বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেছেন , ‘সুদের হার বেশি হওয়ার কারণেই আমাদের এখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি। এত বেশি সুদহার বিশ্বের কোথাও নেই। একইভাবে এখানে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গণনা করা হয়। দণ্ডসুদও আরোপ করা হয়। এতে করে ব্যাংকের টাকা শোধ হয়েও যেন হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণেই ননপারফরমিং লোনের পরিমাণ বেশি এবং এটি এই মুহূর্তে আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই আমরা সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। মনে রাখতে হবে, সব নাগরিকের কষ্টার্জিত অর্থ খেলাপি হচ্ছে। তাই আজ আমরা সবাই বসেছিলাম কীভাবে সুদের হার কমানো যায়, অথবা কমপিটিটিভ একটা এনভায়রনমেন্টে আনা যায়। সবাই আমরা এক বাক্যে স্বীকার করেছি যে সুদের হার কমাতেই হবে। সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সুদের হার বসাতে হবে। সুদের হার কমলে আমাদের সঙ্গে বিদেশিরা ব্যবসা করে শান্তি পাবে, কোনো প্রশ্ন করবে না। বিদেশিরা আমাদের এলসিগুলো গ্রহণ করবে।’
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বলা হয়েছে সাত সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়ার জন্য। এই কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী, বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিনিধি থাকবেন। কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসে তাদের সুপারিশ প্রদান করবে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমরা সঠিকভাবে সঠিক কাজ করতে পারলে সবকিছুই সম্ভব। আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা ও শিল্পায়নের জন্য কাজ করছি। দেশের সার্বিক উন্নয়নে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে কাজ করছেন। শিল্পায়নের মাধ্যমে আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।’ বিশ্বব্যাপী বড়ো দেশগুলোর বাণিজ্যযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের প্রবৃদ্ধি কমবে না। আমাদের যে সমস্ত আইটেম তৈরি হয়, তার চাহিদা সব সময় আছে। যে সমস্ত আইটেম তৈরি করি, তার চাহিদা সারা বিশ্বে আছে। তাই প্রবৃদ্ধি কমবে না।’ ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় রেমিটেন্স বাড়ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এর আগে রবিবার সকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে তার শেরেবাংলা নগরের কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেন জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জেবিআইসি) ডেপুটি গভর্নর নবুমিতসু হায়াশি। এ সময় তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন এবং জাপানিদের বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানান, বিশেষ করে বিদ্যুত্ খাত ও চিনিশিল্প খাতে তারা বিনিয়োগ করার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করেন।ত
সুদহারে সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এ কমিটির প্রধান হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান। এ কমিটির সদস্য সচিব অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরামউদ্দীন আহমেদ, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, রূপালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সরোয়ার এবং এনআরবি ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসাইন।
গতকাল রবিবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যাংকের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠকে এ কমিটি গঠনের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক এ কমিটি করে। এ কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে কী কাজ করবে সে বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা জমা দেবে। আর তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের শুরুর দিন অর্থাত্ ১ জানুয়ারি থেকে উত্পাদনশীল ও শিল্প খাতের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply