প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত ঘনবসতিপূর্ণ বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে করোনায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হার। নারায়ণগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের হার বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে একাধিক চিকিত্সক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরু থেকেই করোনা ভাইরাসকে গুরুত্ব দেয়নি নারায়ণগঞ্জবাসী। এমনকি এখন যে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তার পরও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। করোনা সংক্রমণকে এখনো তারা খুবই হালকাভাবে নিচ্ছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৫৮ জন। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, আক্রান্তের তুলনায় তা নগণ্য। কারণ উপসর্গের তুলনায় খুবই কমসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেশিসংখ্যক মানুষকে করোনা পরীক্ষা করা হলে শনাক্তের সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে। আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। প্রতি ৮ ঘণ্টায় এক জনের মৃত্যু হচ্ছে এ জেলায়। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৩৯ জন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাই নারায়ণগঞ্জকে প্রথমে ক্লাস্টার, পরে রেড জোন, সবশেষে এপি সেন্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
নারায়ণগঞ্জে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে প্রধানত চারটি কারণ চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত বিদেশফেরতদের চিহ্নিত করতে না পারা এবং সর্বত্র এদের অবাধ বিচরণ, যার মধ্যে দেশের প্রথম শনাক্ত দুই ইতালি প্রবাসী রয়েছেন। দ্বিতীয়ত, এ রোগে প্রথম মৃত্যু হওয়া লাশ দাফন করা হয় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, সেখান থেকেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, গত ৫ এপ্রিল জেলায় কয়েক লাখ শ্রমিকের প্রবেশ। চতুর্থত, লকডাউন না মানা।
গত ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে জেলায় কয়েক লাখ শ্রমিকের প্রবেশ ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার প্রবাসী নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন মাত্র ১ হাজার ১৫০ জন প্রবাসীকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠালেও নজরদারি না থাকায় তারা কেউ-ই সেইভাবে নিয়মকানুন মানেননি। এ ছাড়া ৮ মার্চ সর্বপ্রথম দেশে যে তিন জন করোনা আক্রান্ত চিহ্নিত হন, তারা শরীরে ভাইরাস নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। যদিও তারা চিকিত্সা নিয়ে এখন সুস্থ।
এদিকে নারায়ণগঞ্জে করোনা উপসর্গ নিয়ে ৩০ মার্চ প্রথম মারা যান বন্দরের এক নারী। অথচ কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে দেওয়া তার মৃত্যু সনদে লেখা ছিল ব্রেন স্ট্রোকের কথা। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে দাফন করা হয়। কিন্তু মৃতদেহের নমুনা পরীক্ষা করে ২ এপ্রিল জানানো হয়, ঐ নারীর করোনা পজিটিভ ছিল। পরে দাফনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৫ জনকে কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়। লকডাউন করা হয় শতাধিক পরিবারকে। তাদের অনেকেই এখন করোনায় আক্রান্ত। একই অবস্থা হয় নারায়ণগঞ্জে অন্তত আরো দুই জনের মৃত্যুর পর। এ ছাড়া শিল্পনগরী হওয়ায় এ জেলায় শত শত পোশাক কারখানা রয়েছে। সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে নারায়ণগঞ্জে আসেন গ্রাম থেকে ফেরা প্রায় ৮ লাখ শ্রমিক। শ্রমজীবী এসব মানুষের মিছিলের সঙ্গেও করোনা ছড়িয়েছে বলে ধারণা করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। এছাড়া করোনা চিকিত্সায় খুবই অবহেলার শিকার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের রোগীরা। প্রথম দিকে অনেক রোগী উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। শহরের জামতলা এলাকার এক গৃহিণী আইইডিসিআরে ফোন করে জানান, তার স্বামী করোনা পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে। বর্তমানে তিনিও করোনা উপসর্গ নিয়ে ভুগছেন। কিন্তু তার অনুরোধকে গুরুত্ব দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করানো হয়নি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ জানান, দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত শহরের জয়নাল প্লাজার দুই ইতালি প্রবাসী। তারা দুই জন দেশে আসার পর অন্তত পাঁচ দিন জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছেন। শহরের পপুলার হাসপাতালে জ্বর নিয়ে চিকিত্সা নিতে গিয়েই প্রথম চিকিত্সককে জানান তারা ইতালি থেকে এসেছেন। এরপর ঐ চিকিত্সক তাদের কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠালে সেখানে করোনা ধরা পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মাধ্যমেই এ জেলায় করানো ছড়িয়েছে। এ ছাড়া করোনায় জেলায় প্রথম মৃত্যু হওয়া বন্দরের গৃহবধূর মরদেহ কুর্মিটোলা থেকে প্যাকেট করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি খুলে পরিবার স্বাভাবিকভাবেই জানাজা দেয়। তিনি আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জে পোশাকশ্রমিকেরা ভাসমান। ঘোষিত ছুটি প্রত্যাহারের পর ৫ এপ্রিল দলে দলে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করেন তারা। এ ছাড়া জেলার লোকজনকে কিছুতেই লকডাউন মানানো যাচ্ছে না। আর এ কারণেই নারায়ণগঞ্জে এত দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply