করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ অতিক্রম করেছে। ১৮ জুনের তথ্য অনুযায়ী দেশে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে এক লাখ দুই হাজার ২৯২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৩৮ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ৩৪৩ জনে।
সামনে করোনা পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যেই গত কয়েকদিন ধরে জোন ম্যাপ নিয়ে লুকোচুরি খেলা চলছে, চলছে নানারকম বিভ্রান্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত ১৫ই জুন এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে যে, রেড জোনে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে এবং অন্যান্য এলাকাগুলোতে সীমিত আকারে অফিস খোলা থাকবে। এরপর গণমাধ্যমে ঢাকা শহরের ৪৫ টি এলাকাকে রেড জোন চিহ্নিত করে খবর প্রকাশ শুরু হয়।
আগের দিন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীও বলেছেন যে, যে এলাকাগুলোতে সংক্রমণ বেশি সেই এলাকাগুলোকে রেড জোন চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে আবার দেখা গেল সিদ্ধান্তহীনতা এবং বিভ্রান্তি। পরে বলা হলো যে, রেড জোন ঘোষণা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করবে না, এটা করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে।
কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দেওয়া প্রজ্ঞাপনের ৩ দিন পেরোলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জোন ম্যাপিং চূড়ান্ত করেনি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি যে কোন কোন এলাকাগুলো রেড জোনের আওতাভুক্ত হবে। এই নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র বিষ্ময় প্রকাশ করেছে। এই নিয়ে ইতিমধ্যে দেখা গেছে একাধিক বিভ্রান্তি।
পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব রাজাবাজার যে লকডাউন করা হয়েছিল তাঁর ফল হিতে বিপরীত হয়েছে। এখানে সংক্রমণ আরো বেড়েছে। এর ফলে এই লকডাউন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতিবাচক কোন ভূমিকা তো রাখেইনি, উল্টো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দ্বিতীয় জটিলতা দেখা যাচ্ছে যে, যেসব এলাকাগুলোকে বলা হচ্ছে যে সেখানে সংক্রমণ বেশি, বাস্তবে সেখানে আদৌ সংক্রমণ বেশি কিনা তা নিয়ে জটিলতা দেখা গেছে। কারণ যাদের করোনা শনাক্তের পরীক্ষার করা হয়েছে তাঁদের অনেকের বাসার ঠিকানা অনেক ক্ষেত্রে ভুল দেওয়া হয়েছে, মোবাইল নাম্বারের যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে তাঁর সঙ্গে বাস্তব ঠিকানার মিল নেই, এমনকি অনেকে তথ্য গোপন করেছে। যার ফলে এই জোন ম্যাপিংয়ের ফলে কিভাবে সঠিকভাবে করোনা সংক্রমিত এলাকা চিহ্নিত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশেষজ্ঞরা।
আরেক সঙ্কট দেখা গিয়েছে যে, প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং নতুন নতুন এলাকায় রোগী আক্রান্ত হচ্ছে, সাথে বাড়ছে সুস্থ হওয়ার সংখ্যা। তাই যে ম্যাপিং করা হয়েছিল তাঁর পরিবর্তন অবধারিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, একটি এলাকার নির্দিষ্ট জায়গা-সড়ক বা স্থান বন্ধ করে দিলেই যে সংক্রমণ বন্ধ হবে সেটা বাস্তবসম্মত নয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।
কারণ পূর্ব রাজাবাজারে দেখা গেছে যে, লোকজন নানা ছুতোয়, নানা অজুহাতে, নানান কারণ দেখিয়ে এলাকা থেকে বেরিয়ে গেছে। কাজেই এই পরিস্থিতি অন্যান্য এলাকাগুলোতে যে হবে তা নিশ্চিত।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, এতগুলো এলাকাকে আলাদা আলাদাভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে লকডাউন করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি অসম্ভব এবং অবাস্তব চিন্তা। এই বিবেচনা থেকে তাঁরা মনে করছেন যে, এরকম ছোট ছোট এলাকাকে লকডাউন করা মোটেও কার্যকর হবেনা এবং এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
ফলে এর কারণে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটেই বিশেষজ্ঞরা ঢাকা শহরের সবথেকে সংক্রমিত এলাকা ঢাকা মহানগরীকে অন্তত ১৫ দিনের জন্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব করছেন।
তাঁরা বলছেন যে, সংক্রমণ রোধের এটাই একমাত্র উপায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন যেটাকে পিক বলছে, সেই পিকের সংজ্ঞাও বিভ্রান্তিকর। কারণ একটি এলাকাকে যখন সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ বা বন্ধ করে দেওয়া হবে, তখন সংক্রমণের পিক বোঝা যাবে। কিন্তু এভাবে যদি সবকিছু খোলা থাকে তাহলে সংক্রমণ ক্রমশ বাড়তেই থাকবে এবং এর মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপার হয়েও দাঁড়াবে।
এই বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, এখন একটাই পথ আছে, যে এলাকাগুলো সবথেকে বেশি সংক্রমিত যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর- এই এলাকাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে লকডাউন এবং কঠোরভাবে সেই লকডাউন পালন করার কোন বিকল্প নেই। আর এটা করতে গেলে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে দিতে হবে সবকিছু, প্রয়োজনে কারফিউ দিতে হবে।
আর ১৫ দিন ঢাকা বন্ধের একটি প্রস্তাব বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়েছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এখন দেখার বিষয় যে, ছোট ছোট এলাকাগুলোকে লকডাউন করা হয়, নাকি পুরো ঢাকা শহরকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply