স্বাস্থ্য খাতে মাফিয়া ডন বলে খ্যাত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর দৌরাত্ম্য থামছেই না। তার লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির তদন্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে। চার বছর ধরে এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটি নেই। এমনকি দুদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ঘোষিত ‘কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারের’ মধ্যেও তার নাম নেই। চুনোপুঁটিদের ‘কালো তালিকায়’ রেখে কার ছত্রছায়ায় বারবার বেঁচে যাচ্ছেন মিঠু তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে।
নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেওয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন সাবমিশন’ মামলা করেছিল দুদক। স্বাস্থ্য খাতে মিঠুর যাবতীয় কর্মকান্ড ও তার নামে-বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠানো হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মিঠুকে তার সহায়-সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর রহস্যজনক কারণে তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে যায়। কিন্তু থামেনি মিঠু সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৌরাত্ম্য। বরং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তার সিন্ডিকেটের নতুন সদস্য হয়েছেন।
এখনো মিঠুর অঙ্গুলি হেলনেই চলছে স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় টেন্ডার, সরবরাহ ও কেনাকাটার কাজ। ২০১৬ সালে বিশ্ব তোলপাড় করা পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি সংশ্লিষ্টতায় বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারকারী হিসেবে যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম এসেছিল, এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু তাদের একজন। এ কারণে মিঠুর ব্যাপারে দুদকের তথ্যানুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়টি শুরুতে বেশ গুরুত্ব পায়। মিঠুকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান উল্লেখ করে সে বিষয়েও তথ্য চায় দুদক।
২০১৬ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে দুদক যে চিঠি পাঠিয়েছিল তাতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে স্বাস্থ্য সেক্টরে বিভিন্ন উন্নয়ন, সেবা খাতে যে সমস্ত কাজ বাস্তবায়ন করেছে, চলমান আছে এবং ওষুধ-মালামাল-যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোর প্রশাসনিক অনুমোদন, বরাদ্দপত্র, প্রাক্কলন-টেন্ডার, কোটেশন, দাখিলকৃত টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কার্যবিবরণী, কার্যাদেশ, কার্যসমাপ্তি প্রতিবেদনসহ প্রাসঙ্গিক সব রেকর্ডপত্র ২০১৬ সালের ৩০ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক দফা তাগিদ দেওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এসব রেকর্ড আর দুদককে দেওয়া হয়নি। দুদক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট শাখার তৎকালীন লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শামিউল ইসলামের কাছেও চিঠি দেয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ না করায় ওই বছরই দ্বিতীয় দফায় সংস্থার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক স্বাক্ষরিত চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত আর এগোয়নি। বরং চিঠি চালাচালিতে বিষয়টি ধামচাপা পড়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। পরবর্তীতে দুদকও আর মিঠুর বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে প্রায় চার বছর ধরে তার দুর্নীতির তদন্ত থেমে আছে।
স্বাস্থ্য খাতে একক রাজত্ব তার : গত এক যুগ ধরেই স্বাস্থ্য খাতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে মিঠু ও তার সিন্ডিকেট। বিগত মহাজোট সরকারের আমলে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য খাতে একচেটিয়া রাজত্ব করেন আলোচিত এই ঠিকাদার। মিঠুর লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার অসংখ্য ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিনজন পরিচালকও মিঠু সিন্ডিকেটে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মিঠুর নাম উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার মিঠু কীভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই তথ্যও চিঠিতে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক।
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেট টানা বছরের পর বছর ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতে শক্ত জাল বিস্তার করে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর বিশ্বস্ত এজেন্ট। এসব এজেন্টই মিঠুর হয়ে যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পাদন করে থাকে। কখনো উপরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয়, কখনো অর্থের লেনদেনে ম্যানেজ করা হয়। দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন মিঠু। গড়ে তুলেছেন বিত্ত-বৈভব। মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ইউনিয়নে। তিনি বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্য খাত।
মিঠুর উত্থান যেভাবে : মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে মিঠু সিন্ডিকেট আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত। কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে নির্ধারিত যন্ত্রপাতির বদলে পুরনো এবং নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিন জন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। এরা তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের একজন অবসরে চলে গেছেন। মিঠু সিন্ডিকেটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন একজন সহকারী সচিব। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একই শাখায় পদ দখল করে রেখেছেন তিনি। তাকে অন্য কোথাও বদলি করা যায় না। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে সব দেখভাল করেন এই সহকারী সচিব। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের নিচের পর্যায়ের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদফতরে মিঠু সিন্ডিকেটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল দম্পত্তি ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ারও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। মাফিয়া মিঠুর দুর্নীতির সহযোগী আবজালের সূত্র ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ইউনিটের ৪৭ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারেও তদন্ত চালায় দুদক। এদের মধ্যে প্রথম দফায় পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) ডা. আবদুর রশীদ, পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেনকে দুদকে তলব করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ডাকা হয় আরও পাঁচজনকে। তারা হলেন, ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক রাকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। তারা সবাই শীর্ষ মাফিয়া মিঠুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই পরিচিত। খুলনা শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারীও মিঠু সিন্ডিকেটের কল্যাণে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দেশ-বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। একই সঙ্গে তারা নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply