করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই সুযোগে কিছু বেসরকারি হাসপাতালে সেবার নামে চলছে ভয়াবহ বাণিজ্য। এই মহামারীতে রোগীর কাছে থেকে ঘণ্টাপ্রতি অক্সিজেন বিল নেওয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা। সুস্থ মানুষকে করোনার ভয় দেখিয়ে নেওয়া হচ্ছে আইসিউতে। সেবা নিতে গিয়ে লাখ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মহামারীর সময় সরকার যখন চিকিৎসা দিতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালকে বলে তখন এ পরিস্থিতি হওয়ারই কথা। কে কীভাবে চিকিৎসা দেবে, মূল্য নির্ধারণ কীভাবে হবে কোনো গাইডলাইন ছাড়া চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বলা হলো। পাশের দেশ ভারতে এভাবে বেসরকারি হাসপাতালে মহামারীর চিকিৎসা চলছে না। উন্নত বিশ্বের পরিস্থিতি তুলনার তো প্রশ্নই আসে না। মানুষকে জমি, বাড়ি বিক্রি করে এনে বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার বিল দিতে হচ্ছে।
রাজধানীর বনশ্রীর ইয়ামাগাতা-ঢাকা ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে করোনা রোগীর কাছ থেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বাড়তি বিল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। করোনা সাসপেক্টেড রোগী হিসেবে গত ৫ জুন ওই হাসপাতালে ভর্তি হন সতীশ চন্দ্র দাস, রূপালি দাস ও তাদের ছেলে ডা. তন্ময় দাস। এরপর ৯ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সতীশ চন্দ্র দাস। ১৩ জুন তন্ময় দাসের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে, অন্যজনের নেগেটিভ। গত বুধবার তাদের রিলিজ দেওয়ার সময় তাদের হাতে সাত লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। বাড়তি ও অসঙ্গতিপূর্ণ বিল নেওয়ার অভিযোগ করে তন্ময় দাস বলেন, তিনজনের প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টাকা করে অক্সিজেনের বিল ধরা হয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ২০০ টাকা। আমাকে খুব অল্প সময় কম পরিমাণে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিল করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৮০০ টাকা। বাবার আইসিইউতে কার্ডিয়াক মনিটর ফি প্রতি ঘণ্টায় ২০০ টাকা করে ২০ হাজার টাকা এবং আমার ও মায়ের প্রতি ঘণ্টায় ১২৫ টাকা করে ২৮ হাজার টাকা ও ৩৩ হাজার ৭৫০ টাকা নেওয়া হয়েছে। আমি এবং আমার মা একই কেবিনে ভাগাভাগি করে ছিলাম। অথচ দুইবার কেবিন ভাড়া, সার্ভিস চার্জ নেওয়া হয়েছে। আমার বাবার কনসালটেনশন ফি ২১ হাজার ৯০০ টাকা, আমার ৩৪ হাজার ৯০০ টাকা এবং মায়ের ৪১ হাজার ৭০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত বিল নেওয়ার বিষয়ে আমরা আরও বুঝতে পারি খাবারের বিল থেকে। আমাদের যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার দিয়ে গেছে সেই ম্যানেজার আমাদের কাছে বিল পাঠিয়েছেন দুই হাজার ১৫০ টাকা। এটা হয়তো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খেয়াল করেনি। তারা আবার মোট বিলের সঙ্গে খাবারের বিল দিয়েছে ১১ হাজার টাকা। আমাদের হাতে রিলিজ দেওয়ার সময় সাত লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার ওষুধ আমাদের আলাদা কিনতে হয়েছে। চিকিৎসার নামে রোগীদের গলাকাটা ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান হাওলাদার গত ৩১ মে থেকে পেটের সমস্যায় ভুগছিলেন। ২ জুন কয়েকটি টেস্ট শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসক জানান তার শরীরে সোডিয়াম কমে গেছে। এরপর তার পরামর্শে ইয়ামাগাতা-ঢাকা ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে যান। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালে যাওয়ার পরে আমাকে আইসিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়। এরপর ক্যানোলা লাগিয়ে শুইয়ে রাখা হয়। কিন্তু আমার কোনো ধরনের টেস্টই করা হয়নি। আইসিউতে নোংরা পরিবেশ এবং বিছানা ছাড়া কোনো ধরনের যন্ত্রপাতিও নেই। তারা আমাকে বিছানায় শুইয়ে হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দেয়। আমাকে আইসিইউতে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ওই বিছানার সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর টানা সাত দিন আমাকে শুধু ঘুমের ওষুধ আর ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়। আমি সারা দিন অচেতন অবস্থায় ঘুমাতাম। আমার স্ত্রীকে বলা হয় আমার করোনা হয়েছে। অথচ আমার কোনো টেস্টই করা হয়নি। এক সময় আমি জানতে পারি এভাবে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। তখন আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসতে চেষ্টা করি। তারা আমাকে জোর করে আটকে রাখে। বিল পরিশোধ করলে আমাকে আসতে দেয়। আমি হেঁটে হাসপাতালে গেলাম অথচ আমাকে জোর করে আইসিইউতে ঢুকিয়ে এভাবে টাকা আদায় করা হলো। এভাবে রোগীদের ফাঁদে ফেলে ব্যবসা করছে হাসপাতালটি। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। এ ব্যাপারে কথা বলতে ইয়ামাগাতা-ঢাকা ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের হটলাইনে ফোন করে যোগাযোগ করলে হাসপাতালের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানকে দেওয়া হবে বলে কিছুক্ষণ লাইনে রেখে কেটে দেওয়া হয়। এরপর ফোন দিলেও আর কেউ রিসিভ করেনি। রাজধানীর মালিবাগের প্রশান্তি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা মহিন উদ্দীন পারভেজ। গত বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি মারা যাওয়ার পর তার লাশ নিতে গেলে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় পরিবারের কাছে। পরিবারের অভিযোগ, রোগীকে আইসিইউতেও রাখা হয়নি তাহলে এত বিল কীভাবে আসে? এই অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ বুঝিয়ে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করে ওই ভুক্তভোগী পরিবার। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এই দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এখন ব্যবসা নয় মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে আমাদের নামতে হবে। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় মানবিক হওয়ার আহ্বান থাকবে সবার প্রতি।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply