পড়ালেখা করেছে এসএসসি ফেল। বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই। চিকিৎসা পেশায় নেই কোনো ডিগ্রি কিংবা সার্টিফিকেট। নেই কোনো ল্যাবও। তবে নিজেকে পরিচয় দিতেন কেমিস্ট হিসেবে। পড়াশোনা কম থাকায় চাঁদপুরের মালয়েশিয়াপ্রবাসী পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে ফোনে পরামর্শ নিয়ে নকল ও ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিক্সিং করে নেমে যান ‘নকল সুরক্ষা সামগ্রী’ বানানোর কাজে। করোনাভাইরাসে যখন সবার ঘুম হারাম, তখন নকল সামগ্রী বানানোর কাজটি পুরোদমে শুরু করেন। ব্যবসার সুবিধার্থে তিন সহযোগীকে নিয়ে গড়ে তোলেন এআর চট্টলা কেমিকেল নামক প্রতিষ্ঠান। যে কারখানায় দিন-রাত চলে নকল পণ্য বানানোর মহাযজ্ঞ। চট্টগ্রাম মহানগরের পাশাপাশি ১৫ উপজেলার বড় প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয় তৈরিকৃত নকল পণ্যসামগ্রী। লাভজনক হওয়ায় দিনাজপুর, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, কুমিল্লা, খাগড়াছড়িসহ দেশের আরও কয়েকটি স্থানে কুরিয়ারে নকল পণ্য পাঠানো শুরু করা হয়। আর এভাবে নকল পণ্য বানিয়ে তা বিক্রি করে কোটিপতি বনে যান এসএসসি পাস না করা মো. রাশেদ!
জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর জেনেও নকল পণ্যসামগ্রী বানিয়ে তা বিক্রি করে কয়েক মাসে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তরুণ এই প্রতারক। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এত কম বয়সে রাশেদের কোটিপতি হওয়ার অন্ধকারের গল্প।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেমিক্যালের ব্যবসা দিয়ে ২০১২ সাল থেকে ব্যবসায় নামেন মো. রাশেদ। এতে তেমন লাভ না হওয়ায় চাঁদপুরের মালয়েশিয়াপ্রবাসী মো. নয়ন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ফোনে পরামর্শ নেন। তিনিও একজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া কেমিক্যাল দিয়ে রাশেদ মিক্সিং করে নকল পণ্যসামগ্রী তৈরিতে নেমে পড়েন। গত মার্চ মাসে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর চট্টগ্রামে সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগান রাশেদ। সঙ্গে নেন তিন সহযোগী আকবর হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও মো. খোকন। তাদের সঙ্গে কারখানায় ম্যানেজার হিসেবে কুমিল্লার বাসিন্দা মো. ফয়েজ উল্লাহ, ব্যাটারি টেকনেশিয়ান হিসেবে গোপালগঞ্জের আবদুল মাজেদ সরদার ও চালক হিসেবে খুলনার স্বদেব দাশকে দায়িত্ব দেন। তাদের নিয়ে গোপনে দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত হয়ে পড়েন নকল সামগ্রী তৈরিতে। পণ্যের তালিকায় আছে করোনাভাইরাসের অন্যতম স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, সাবান, ক্লিনারসহ কয়েকটি পণ্য। নকল পণ্য তৈরি করতে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট এলাকার মধ্যম সুপারিওয়ালা পাড়ায় গড়ে তোলেন এআর চট্টলা কেমিক্যাল নামক প্রতিষ্ঠান। এখানকার কারখানায় গোপনে নকল পণ্যসামগ্রী বানানোর কাজটি করেন রাশেদ। এখান থেকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট রেয়াজউদ্দিন বাজার, গোলাম রসুল মার্কেট, হাজারী গলির ওষুধের দোকান, তামাকুমি লেনসহ ১৫ উপজেলায় থাকা বেশ কয়েকটি প্রধান মার্কেটে নকল পণ্য পাঠান তিনি। ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে নকল পণ্য দিনাজপুর, পিরোজপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, কুমিল্লা, খাগড়াছড়িসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
দেশের বিভিন্ন জেলা ও শহরে অনলাইনের মাধ্যমেও নকল পণ্যের এই ব্যবসা পরিচালনা করেন রাশেদ। করোনার সময়ে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালাতে গিয়ে বেশিরভাগ দোকান থেকে এআর চট্টলা কেমিক্যাল স্টিকার সংবলিত নকল ও ক্ষতিকর বিপুল পণ্যসামগ্রী উদ্ধার করে প্রশাসন। কিন্তু কোনোভাবেই খোঁজ মেলানো যাচ্ছিল না প্রতিষ্ঠানটির সঠিক অবস্থান। এতে ঘুম হারাম হয়ে যায় প্রশাসনের। পরে কারখানার সন্ধানে নামে প্রশাসন। সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট এলাকার মধ্যম সুপারিওয়ালা পাড়ায় গিয়ে সেই নকল পণ্য তৈরির কারখানার সন্ধান পায় তারা। কারখানায় সরেজমিন গিয়ে পিলে চমকানোর মতো দৃশ্য দেখতে পান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুকসহ নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তারা। ক্ষতিকর কেমিক্যাল দিয়ে সুরক্ষা সামগ্রী বানানোর সময় মো. রাশেদকে হাতেনাতে আটক করেন ম্যাজিস্ট্রেট। কারখানাটিতে নকল পণ্য বানাতে শতাধিক ড্রামে মজুদ করা হয় ক্ষতিকর কেমিক্যালসহ ভেজাল নানা পণ্য। কেমিস্ট ও ল্যাব ছাড়াই কারখানার মালিক রাশেদ নিজের হাতে কেমিক্যালগুলো মিশ্রণ করে তার কোম্পানির লেভেল লাগিয়ে বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করেন। কারখানা থেকে ২০ লাখ টাকার ক্ষতিকর কেমিক্যাল, নকল ও ভেজাল সামগ্রী জব্দ করা হয়। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘করোনার কারণে সবাই এক কঠিন সময় পার করছে। এমন দুর্দিনে নকল পণ্য তৈরি করে যে অপরাধ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রামের ছোট-বড় বেশ কয়েকটি বাজারে অভিযান চালিয়ে এআর চট্টলা কেমিক্যালের স্টিকার সংবলিত নকল সুরক্ষা সামগ্রীর সন্ধান পাই। বিষয়টি আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কারখানাটির সন্ধানে মাঠে নেমে পড়ি। এক পর্যায়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কারখানার ঠিকানা মেলে। তাৎক্ষণিক সেখানে গিয়ে নকল কেমিক্যাল দিয়ে সুরক্ষা সামগ্রী বানানোর সময় হাতেনাতে আটক করি প্রতিষ্ঠানের মালিক রাশেদকে। গত কয়েক মাসে বিপুল পরিমাণ নকল সামগ্রী বানিয়ে তা বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সে। বিষয়টি আমাদের কাছে স্বীকারও করেছে। রাশেদের সঙ্গে আর কারা জড়িত, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
গুরুতর এই অপরাধের কারণে মো. রাশেদকে ছয় মাসের কারাদ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি। রাশেদ চাঁদপুরের সেনগাঁওয়ের আনোয়ার মুন্সীর ছেলে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply