লোভ লালসার কারণে সৃষ্টি হয় অপরাধ ও অনৈতিক কার্যকলাপ। লোভ-লালসা হচ্ছে সৃষ্টির সেরা মনুষ্য চরিত্রের দুর্বলতম ও হীনতম বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম একটি। যার সাহায্যে সৃষ্টি হয় অন্যায় ও অবৈধ কাজের বিভিন্ন রাস্তা। অতএব আত্মার অবৈধ প্রবৃত্তির একটা বাস্তবরূপ লোভ-লালসা। যা মানুষের পারিবারিক জীবনে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করে নানা সমস্যা এবং নিরাপত্তাহীন অশান্তির অস্বস্তিকর পরিবেশ। আপন সহোদরদের মধ্যে ধন-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, ভাই-বোনের সম্পর্ক নষ্ট, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কে বিচ্ছেদ এবং পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা এবং দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ায় মানুষের লোভাতুর প্রকৃতি অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষই প্রবৃত্তির এই অদৃশ্য শক্তিশালী চাহিদার শিকার হয়। নাফস শয়তানই এই অবৈধ প্রবৃত্তিকে মনুষ্য চরিত্রে লালন করতে সাহায্য করে। তাই মানুষের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞতাবশত এই প্রবৃত্তির দাসত্বে আত্মসমর্পণ করে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকান এর ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াতে বলেছেন, “তুমি কি এমন লোককে দেখতে পাও যে তার নিজের বাসনাকে তার আরাধ্য হিসেবে গ্রহণ করে ? তুমি তার বিষয়াদির ব্যবস্থাপক হতে পারবে ?” “তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশ শোনে বা বোঝে? তারা কেবল গবাদি পশুর মতো বরং তারা অধিকতর পথভ্রষ্ট।” লোভ-লালসার প্রকৃতিতে আত্মসমর্পণ করে অন্যায়ভাবে অপরের ধন-সম্পত্তি আত্মসাত্ করায় এবং মানুষের মান-সম্মান ধূলিসাত্, এমনকি অন্যদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। পার্থিব জীবনে স্বাবলম্বীর প্রত্যাশায় ও প্রচেষ্টায় অবৈধভাবে ধন-সম্পত্তি উপার্জনের আসক্তিতে মানুষ পারলৌকিক জীবন ভুলে যায়। প্রচুর পরিমাণে ধন-সম্পত্তি থাকলেও, তার কোনো তৃপ্তি নেই সে আরো বেশি চায়। অর্থাত্ ধন-সম্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের প্রবৃত্তিতে পরিতৃপ্তির কোনো স্থান নেই। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সূরা আদিয়াত এর ৬, ৭ ও ৮ নং আয়াতেবলেছেন, “মানুষ অবশ্যই তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।” “এবং সে অবশ্যই এ বিষয়ে অবহিত [নিজেদের কাজকর্মে তার প্রমাণ]” “এবং অব্যশই সে ধন-সম্পত্তির আসক্তিতে প্রবল।” অন্যত্র সূরা তাকাসুর এর আয়াত নং ১, ২ ও ৩ এ আল্লাহ বলেন “প্রাচুর্যের [ধন-সম্পত্তির] প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে। “যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও। “এটা সঙ্গত নয়, তোমরা শীঘ্রই এটা জানতে পারবে [মৃত্যুর পরমুহূর্তেই]” সূরা ফজর এর আয়াত ১৯ ও ২০ এ আল্লাহ বলেন “এবং তোমরা উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ করে ফেল।” “এবং তোমরা ধন-সম্পদ অতিশয় ভালোবাস।”
এ সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন, ‘যদি কোনো মানুষের এক উপত্যকা ভরা স্বর্ণ থাকে, তবে সে তার জন্য দুটি উপত্যকা [ভর্তি স্বর্ণ] হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে। তার মুখ মাটি ছাড়া [মৃত্যু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত] আর কিছুতেই ভরে না। আর যে ব্যক্তি তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন।” [সহীহ আল-বুখারী, খণ্ড ৫, ৪৭০৪ ] অর্থাত্ কবরে না যাওয়া পর্যন্ত ধন-সম্পত্তি উপার্জনে এবং জমা করায় মানুষ ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকলেও অধিকাংশ মানুষই পরিতৃপ্ত হূদয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে বলে না আলহামদু লিল্লাহ, আমার আর প্রয়োজন নেই। অনেকে ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও সবর করতে পারে না বরং ধন-সম্পত্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে অনেকেই আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়। সে মনে করে ধন-সম্পত্তিতে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, তাই কারোর ওপর আর নির্ভরশীল নয়। সে কাউকে পরওয়া করে না অর্থাত্ তখন তার প্রকৃতি হয়ে যায় ঔদ্ধত্যপরায়ণ। সে ভুলে যায় যে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করার জন্যই ধন-সম্পদ দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তদুপরি ধন-সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সে ভুলে যায় মৃত্যুর কথা, আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফিরে যাওয়ার কথা এবং শেষ বিচার দিবসে ধন-সম্পদের হিসাব দিতে আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে হাজির হওয়ার কথা। ফলে ধন-সম্পদের মাধ্যমেই সে পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকতে চায় অথবা মনে করে ধন-সম্পত্তি তাকে অমর করে রাখবে। সূরা আল-হুমাযা, ১-৩ নম্বর আয়াতে এই প্রকৃতির লোকদের উদাহরণ দিয়ে ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ১ : দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে [উদ্ধত দেখিয়ে] ২ : যে অর্থ জমায় ও তা বারবার গণনা করে; ৩ : সে ধারণা করে যে, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে; ৪ : কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় [ধ্বংসিত অগ্নিতে]
অতিশয় লোভ-লালসায় অর্থ-সম্পদ উপার্জনে ও জমা করায় এবং বারবার গণনায় এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যস্ত থাকায় সে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত থেকে দূরে থাকে অথবা অনেকেই ইবাদতের ধার ধারে না। তদুপরি ধন-সম্পত্তির গরিমায় সে হয় উদ্ধত এবং কাজ কর্মে সত্য বিমুখতা এবং আল্লাহ তা‘আলার উপদেশের [আল কুরআনের] বিরুদ্ধাচরণ করা হলো, তার [অনেক ধনীদের] স্বভাব। এই ধরনের লোকদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন, ১১ : আমাকে [আল্লাহকে] ছেড়ে দাও এবং তাকে [সত্যের বিরুদ্ধাচারীকে] যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অসাধারণ [ধন-সম্পত্তি উপার্জনের জ্ঞান/বুদ্ধি সাহায্যে] করে। ১২ : আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধন-সম্পদ ১৩ : এবং নিত্য সঙ্গী পুত্রগণ ১৪ : এবং তাকে দিয়েছি স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের প্রচুর উপকরণ ১৫ : তার পরেও সে কামনা করে যে, আমি তাকে আরও অধিক দেই ১৬ : ‘না, তা হবে না, সে তো আমার নিদর্শনসমূহের [আল কুরআন এবং আল-হাদিস] উদ্ধত বিরুদ্ধাচারী। ১৭ : আমি অচিরেই তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করব। (সূরা মুদ্দাসসির)
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নাফস শয়তানের চাহিদায় লালিত লোভ-লালসা আত্মীয়-স্বজনের প্রাপ্য অংশ এবং ইয়াতিমের পাপ্য আত্মসাত্ করতে মানুষকে বাধ্য করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ১৮৮ : তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার জন্যে [কোনো প্রকার ঘুষ বা প্রভাব দ্বারা] বিচারকদের নিকট পেশ করো না। (সূরা বাকারাহ); ১৪ : নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্ব্বরাজি, গবাদি পশু এবং ক্ষেত খামারের প্রতি আসক্তি [ভোগাসক্তি, মায়ামহব্বত, চিত্তাকর্ষণ] মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে। এই সব ইহ-জীবনের ভোগ্যবস্তু। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট উত্তম আশ্রয়স্থল। (সূরা আলে ইমরান); ২ : ইয়াতিমদেরকে তাদের ধন-সম্পদ প্রদান করবে এবং ভালোর সাথে মন্দ বদল করবে না। তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না; এটা মহাপাপ। ১০ : যারা ইয়াতীমের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষণ করে; তারা জ্বলন্ত আগুনে জ্বলবে। (সূরা নিসা); ২৬ : আত্মীয়-স্বজনকে দিবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও পর্যটককেও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। (সূরা ইসরা); ৩৮ : অতএব আত্মীয়কে দিও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের জন্য এটা শ্রেয় এবং তারাই সফলকাম। (সূরারূম)
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply