দুর্ধর্ষ সাহেদের দেওয়া চাঞ্চল্যকর তথ্যে বিব্রত তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। ১০ দিনের রিমান্ডে থাকা সাহেদের জবানিতে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম আসায় এক ধরনের অস্বস্তিতে ভুগছেন তারা। এ মুহূর্তে তাদের অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ না করলেও তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তবে আদালতে দেওয়া সাহেদের জবানবন্দি সংযুক্ত করে এ-সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত প্রতিবেদন তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পেশ করবেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে সাহেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রতারণা মামলার তদন্তভার র্যাবকে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে প্রতিদিনই বাড়ছে সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত র্যাব সদর দফতরে ১৫০টি অভিযোগের বিপরীতে সাড়ে ১২ কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগ পেয়েছে র্যাব। এছাড়া সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মেট্রোরেলের সাব-কন্ট্রাকটর রেজাউল করিম।
জানা গেছে, সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে বেশির ভাগ প্রতারণার। তবে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সাহেদের অমানবিকতা রূপকথাকেও হার মানাবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাহেদের ফাঁদে পড়তে বাধ্য হয়েছেন। তবে সাহেদ তার অপকর্মের কাহিনি আড়ালে রেখে বিভিন্ন টার্গেট হাসিলের পেছনে অনেক প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকার বিষয়টি উঠে আসায় বিব্রত বোধ করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা গণমাধ্যকে বলেছেন, অভিযোগপত্রে বিস্তারিত উল্লেখ না করা হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে বিশেষ প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ওপরমহল থেকে এ-সংক্রান্ত বার্তাও দেওয়া হয়েছে তাদের।
এদিকে র্যাবের কাছে আসা ১৫০টি অভিযোগের মধ্যে অন্যতম সুনামগঞ্জের ছাতকের এখলাস খানের অভিযোগটি। ২০১৯ সালের শুরুতে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের একটি অনুষ্ঠানে সাহেদের সঙ্গে তার পরিচয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এডিসি ও পদ্মা সেতুতে পাথর সরবরাহকারী হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় তাকে খুব আস্থার সঙ্গে নেন এখলাস। একে একে সাহেদকে সরবরাহ করেন প্রায় দুই কোটি টাকার পাথর। মাঝে মধ্যে তাকে কিছু টাকা দিতেন সাহেদ। তবে চলতি বছরের মে মাসে সাহেদের কাছে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বিল জমা দেন এখলাস। সাহেদকে ওই সময় তিনি বলেন, দ্রুততর সময়ের মধ্যে তার একটি ড্রেজার মেশিন কিনতে হবে। এ জন্য তার ১ কোটি ৬ লাখ টাকা অতীব প্রয়োজন। সাহেদও অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশে ড্রেজার সরবরাহ করেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রতিনিধিকে ডেকে তার অফিসে আনেন। সাহেদ ওই কোম্পানিকে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার এলসি দিয়ে ড্রেজার মেশিন আনার ক্রয়াদেশ দেন। ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরে যান এখলাস। তবে মাত্র এক সপ্তাহ পরে ওই কোম্পানির প্রতিনিধিকে ফোন করলে জানতে পারেন, সাহেদ ওই এলসি ফিরিয়ে নিয়েছেন তাকে অন্ধকারে রেখে। সত্যতা জানতে সাহেদকে ফোন দিলে তা কেটে দেন। চলতি মাসের ৩০ জুন সাহেদের উত্তরা ১২ সেক্টরের অফিসে গেলে এখলাসের মাথায় পিস্তল ঠেকান তিনি। সাহেদ হুমকি দেন, এ বিষয়ে আবার বিরক্ত করা হলে তাকে গুলি করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন।
কক্সবাজারে শাহপরান দ্বীপে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করছিলেন সাহেদ। গত বছর জুন মাসে সাহেদের প্রতিষ্ঠানকে শ্রমিক সরবরাহ করেছিলেন কলাবাগানের সফিকুর রহমান। ঈদের আগে শ্রমিকদের বিল দিতে সাহেদের উত্তরা অফিসে যান সফিকুর। ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকার বিল জমা দিলে সাহেদ পিস্তল ঠেকান সফিকের মাথায়। একটি কক্ষে আটকে রেখে উল্টো একটি স্ট্যাম্পে সফিকের স্বাক্ষর রেখে তার কাছে ২ কোটি টাকা পাওনা বলে লিখিয়ে নেন সাহেদ।
উত্তরা হাউস বিল্ডিংয়ের ওয়ালটন শোরুমের মালিক রুহুল আমিন। ২০১৭ সালে মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য ফ্রিজ, টিভি, মোটরসাইকেল নেন সাহেদ। কিছু টাকা নগদ আর কিছু বাকি রাখার পর ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা সাহেদের কাছে পান রুহুল আমিন। তবে পাওনা টাকার জন্য সাহেদের অফিসে গেলেই রাজ্যের ব্যস্ততা দেখাতেন তিনি। চেক দিলেও তা বাউন্স হয় দফায় দফায়।
এদিকে র্যাবের সদর দফতরের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাবকে সাহেদের প্রতারণা মামলার তদন্তভার দিয়েছেন এ বিষয়টি আমরা শুনেছি। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো লিখিত কাগজপত্র হাতে পাইনি। কাগজ হাতে পাওয়ার পরই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঠিক করে ডকেট আমরা নিয়ে আসব এবং সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।’
প্রসঙ্গত, ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। পরে রোগীদের সরিয়ে রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে পলাতক ছিলেন সাহেদ। তবে ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরদিন ১৬ জুলাই সাহেদ এবং রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। আর সাহেদের প্রধান সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। মামলার তদন্তভার এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply