এম শহিদুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ শিক্ষা সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গাইলের অন্যতম ঐতিহ্য মধুপুরের সুস্বাদু ও রসালো ফল আনারস। টাঙ্গাইল জেলার বিখ্যাত গড়াঞ্চল মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী ফল আনারসের উপর বিষাক্ত রাসায়নিক হরমোন ব্যবহারের কারণে ভোক্তাদের যখন আগ্রহ হারাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে বিষাক্ত কেমিক্যাল মুক্ত এই আনারস চাষে এগিয়ে এসেছেন তরুণ ও শিক্ষিত ক’জন আনারস চাষী। যারা আনারসের চাষ, এর গুণাগুণ সংরক্ষনের প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মধুপুর উপজেলার মহিষমারা ইউনিয়নের হলদিয়া গ্রামের আনারস চাষী সরকারি কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম। চাকুরির পাশাপাশি নিজের জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করে তিনি চাষ করেছেন দুই জাতের আনারস। তিনি আনারসের অকাল বৃদ্ধি ও অতিমুনাফার লোভে হরমোনের প্রয়োগ করেন নাই আবার দ্রুত পাকানো ও ভাল রঙের জন্য রাইপেন নামক বিষাক্ত কেমিক্যালও ব্যবহার করেন নাই। তিনি বলেন দীর্ঘ সময় ধরেই মধুপুরের আনারস চাষীরা কখনও লোভে পড়ে, কখনও অসাধু ব্যবসায়ী ব্যপারীদের খপ্পরে পড়ে একাধিক জাতের আনারস চাষে বিবিধ রাসায়নিক ব্যবহার করে আসছেন।
এই ধরনের চাষাবাদ- অনৈতিক, জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকী এবং পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংসকারী। নজরুল ইসলামের মতই আর একজন উচ্চশিক্ষিত আনারস ও অন্যান্য ফল চাষী ছানোয়ার হোসেনও নজরুল ইসলামের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন। ছানোয়ার হোসেনের বাড়ী গারোবাজার এলাকায়। নজরুল ইসলাম জানান, তিনি এবার বিষমুক্ত ও রাসায়নিকমুক্তভাবে আনারস চাষে বিনিয়োগ করেছেন তিন লাখ টাকা। আশা করছেন তার বাগানের ফল তিনি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেমিক্যালমুক্ত সুস্বাদু আনারস বিক্রি করতে পারবেন। তিনি সামনের বছরে এই চাষ আরও বৃদ্ধি করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিষমুক্ত আনারস চাষের বিষয়ে ছানোয়ার হোসেন বলেন, তাকে দেখে এবং চাহিদার কারণে এলাকার অনেকেই এ পদ্ধতির আনারস চাষে এগিয়ে আসছেন। বিষমুক্ত আনারস চাষ করে ভাল দামও পাচ্ছেন এলাকার চাষীরা।
নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের তরুণ শিক্ষিত কর্মী ও নিরাপদ খাদ্য বিপণনের পথিকৃৎ টাঙ্গাইলের আওয়াল মাহমুদ মধুপুরের আনারস বিগত কয়েক বছর যাবৎ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে আসছেন। তিনি জানান, বিষ ও কীটনাশকমুক্ত আনারসের চাহিদা ব্যাপক। এতে তিনি নিজেও যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমনি চাষীরাও লাভবান হচ্ছেন আর ভোক্তারা পাচ্ছেন নিরাপদ খাদ্য। এবার তিনি ৫০ হাজার জলডুগি এবং ২০ হাজার ক্যালেন্ডার জাতের আনারস নজরুল ইসলামের বাগান হতে আনারস ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করেছেন। তিনি আনারসের ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করেছেন। তিনি জানান, হরমোন ও রাইপেনযুক্ত আনারস যেখানে পচিশ থেকে ত্রিশ টাকায় বিক্রি হয় সেখানে ক্রেতারা বিষমুক্ত জলডুগি আনারস ৫০ টাকা এবং ক্যালেন্ডার আনারস ৭০/৮০ টাকায় ক্রয় করেন। এটি ক্রেতাদের ইতিবাচক মানসিকতা।
টাঙ্গাইলের স্বেচ্ছাসেবক সমাজ কর্মী মির্জা শাহজাহান জানান বিষমুক্ত আনারস স্বাদে অতুলনীয় এবং দেখতেও সুন্দর। স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। বর্তমান করোনা কালে এই আনারসকে তিনি রোগ প্রতিরোধক হিসাবে মনে করেন। সব মিলিয়ে মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু জলডুগি ও ক্যালেন্ডার জাতের আনারস চাষে এক বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। দাম একটু বেশী হলেও স্বাস্থ্য সচেতন ক্রেতারা হাসিমুখেই ক্রয় করছেন সুস্বাদু কেমিক্যালমুক্ত এই আনারস। উৎপাদনকারী ও ক্রেতাদের সচেতনায় মধুপুরের আনারস তার হারোনো গৌরব ফিরে পেতে যাচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা তো বটেই, সারাদেশে পৌঁছে যাচ্ছে বিষমুক্ত রাসায়নিক মুক্ত নজরুলের ও ছানোয়ারের আনারস। তবে ব্যতিক্রমও আছে। এখনও অধিকাংশ আনারস চাষী হরমোন প্রয়োগের দ্বারাই আনারসের বৃদ্ধি সাধন করেন অধিক লাভের আশায়। এমনি একজন চাষী শামছুল হক। তার বাড়ী আউশনারা। তিনি বলেন- “হরমোন প্রয়োগ না করলে ভাল দাম আসে না। আনারস সাইজে ছোট হয়। রঙ থাকে সবুজ। এসবের চাহিদা কম।” যদিও তার বক্তব্যের সাথে সাধারণ জনগণ একমত না। মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, মধুপুর অঞ্চলে প্রায় দুই লাখ টন বিভিন্ন জাতের আনারস জন্মে এবং সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে প্রতি বৎসর আনারস চাষ হয়।
এছাড়া মধুপুর সংলগ্ন ঘাটাইল ও ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার তিন হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়। তিনি বলেন, আগের চেয়ে বর্তমানে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার অনেক কমে আসছে। মধুপুর অঞ্চলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের উদ্যোগে আনারসভিত্তিক খাদ্য শিল্প স্থাপনের কার্যক্রম গৃহীত হলে চাষী এবং জনগন ব্যাপক উপকৃত হবে। এছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার ও রাস্তঘাটের উন্নয়ন আনারস চাষে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply