টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ বিদ্যুৎ সংযোগ না দিয়েই এমনকি স্পটে সংযোগের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও পিডিবি’র বিক্রয় ও বিতরন বিভাগ-১ (বিউবো) টাঙ্গাইলের স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়িত্বহীনতায় কোন প্রকার পরিদর্শন না করেই বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়া আবেদনকারির নামে কনজুমার নম্বর বসিয়ে ভৌতিক বিল তৈরি করে, আবার সে বিল খেলাপি দেখিয়ে মামলা দিয়ে কিংবা মামলার ভয় দেখিয়ে নিরীহ জনগণের নিকট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এমনই ঘটনার অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের দাপনাজোর হাকিমপুর পাড়ায়।
বসানো হয়নি এইচটি কিংবা এলটি কোন বৈদ্যুতিক খুঁটি। সেচ মেসিনের ক্ষেত্রে থ্যীফেইস লাইন টানানোর নিয়ম থাকলেও সংযোগ তো দুরের কথা প্রস্তাবিত সেচ প্রকল্প এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার ফুটের মধ্যে নেই এ ধরনের লাইন টানার কোন অস্তিত্ব। দেওয়া হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। চালু হয়নি সেচ। অথচ আবেদনের পাঁচ বছর পর বিল এসেছে প্রায় সোয়া লাখ টাকা। এতদিন কোন প্রকার বিল কখনও পাঠানো হয়নি গ্রাহকের কাছে।
হঠাৎ করেই বিল খেলাপির দায়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অধীনে টাঙ্গাইলের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮০ বছরের শ্যামলা বেগম নামে এক বৃদ্ধার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।
জানা যায়, উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের দাপনাজোর হাকিমপুর গ্রামের মৃত আবদুর সবুর মিয়ার স্ত্রী শ্যামলা বেগম সেচ মেশিনে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়ার জন্য ২০১৪ সালের শেষের দিকে বাসাইল পৌর এলাকার মশিউর রহমান নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ লাইনের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) টাঙ্গাইলের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর (তৎকালিন সখিপুর অফিস) অধীনে আবেদন করেন। ওই সময় দাপনাজোর হাকিমপুর, দেউলী ও মুড়াকৈ এলাকার ১২ জনের কাছ থেকে সেচ মেশিনে বিদ্যুতের লাইন পাইয়ে দিতে মশিউর রহমান ১১ লাখ টাকা নেন। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে তিনি ৯ জনের সেচ মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। এছাড়া নিজ দায়িত্বে বাঁশ, সিমেন্টের খুঁটি ও তার কিনে আরও দুইজন তাদের সেচ মেশিনে সংযোগ নেয়। ওই সময় রহস্যজনক কারণে শ্যামলা বেগমের লাইন না দিয়ে সংশ্লিষ্টরা তার লাইন বাতিলের কথা বলে কাজ শেষ করে চলে যায়। লাইন না পাওয়ায় আদৌ চালু হয়নি শ্যামলা বেগমের সেচ প্রকল্প।
অথচ আবেদনের প্রায় পাঁচ বছর পর সম্প্রতি শ্যামলা বেগমের নামে এক লাখ ১৪ হাজার ৬২৭ টাকা বিদ্যুৎ বিল খেলাপি দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী দফতরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ (বিউবো) এর সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইমুম শিবলী বাদী হয়ে টাঙ্গাইলের ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) বিদ্যুৎ আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। ফলে নিরীহ শ্যামলা বেগম চরমভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ মামলায় আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর বিবাদী শ্যামলা বেগমকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এলাকা পরিদর্শন ছাড়াই বিদ্যুৎ বিভাগের এমন দায়িত্বহী কার্যক্রমে এলাকায় চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ভূক্তভোগিদের মাঝে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে ভুক্তভোগী বৃদ্ধা শ্যামলা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ১২ জন সেচ মেশিনে বিদ্যুতের লাইনের জন্য আবেদন করলে লাইন পাইয়ে দিতে স্থানীয় শফিকুলের মাধ্যমে বাসাইলের মশিউর রহমান সেচপ্রতি ৮০ হাজার করে টাকা নেন। ওই সময় ১১ জন বিদ্যুৎ লাইন পেলেও আমাকে লাইন দেওয়া হয়নি। খুঁটি বসানো হয়নি, টানানো হয়নি তারও।
আমার ৮০ হাজার টাকাও ফেরত দেয়নি। উল্টো আমার নামে এক লাখ ১৪ হাজার ৬২৭ টাকা বিদ্যুৎ বিল করে তা আবার খেলাপি দেখিয়ে আমার নামে বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরা মামলাও করেছে।’ আমাকে বিদ্যুতের লাইনও দেওয়া হলো না, মেসিনই বসাইলাম না এসব কিছু না দেখেই সরকারি অফিসের লোকেরা কিভাবে এমন দায়িত্বহীন কাজা করে?
তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ অফিসের এমন মিথ্যা মামলায় এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে আদালতে দাঁড়াতে হবে। এমনকি বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও বিল খেলাপির অপবাদে জেলেও যেতে হতে পারে। এ ব্যাপারে আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। বিদ্যুৎ অফিসের এমন মিথ্যা হয়রানীর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করার কি কেউ নেই?
শ্যামলা বেগমের ছেলে সুরুজ্জামান বলেন, ‘২০১৪ সালে আমরা একটি সেচ মেশিন করার পরিকল্পনা করে বিদ্যুৎ লাইন আনার জন্য আবেদন করি। তখন নানা অজুহাতে আমাদের লাইনটি বাতিল হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চলে যায়। প্রায় পাঁচ বছর পর আমার মায়ের নামে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভাগের মামলার নোটিশ আসে। তারা মামলার কপির সঙ্গে বিদ্যুৎ বিল পাঠিয়ে দেন। অথচ সেচ মেশিন বা বিদ্যুৎ লাইনের কোনও অস্তিত্বই নাই।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মহসিনুজ্জামান বলেন, ‘বিদ্যুৎ লাইনের জন্য শ্যামলা বেগম আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ খুঁটি স্থাপন বা কোনও তারও টানায়নি, সংযোগও দেয়নি। তারপরও শ্যামলা বেগমের নামে বিদ্যুৎ বিল খেলাপি মামলা হয়েছে। এই মামলা থেকে বৃদ্ধা শ্যামলা বেগমকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
বিদ্যুৎ লাইন পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে টাকা লেনদেনকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৪ সালের শেষের দিকে আমার নিজের একটিসহ ১২টি সেচ মেশিনে বিদ্যুৎ লাইনের জন্য আবেদন করে ইস্টিমেট করি। তখন আমার হাত দিয়েই ১২টি সেচের জন্য বাসাইলের মশিউর রহমানকে ১১ লাখ টাকা দেই। সেই সময় ১১টি সেচ মেসিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু শ্যামলা বেগমের সেচ পয়েন্ট পর্যন্ত কোনও প্রকার খুঁটি স্থাপন বা তার টানানোই হয়নি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও কোন সুরাহা হয়নি। তারা বলে এ লাইন বাতিল হয়ে গেছে। শ্যামলা বেগমের লাইন আর হবে না।
বিগত পাঁচ বছর শ্যামলা বেগমের নামে কোনও বিদ্যুৎ বিলও আসেনি। হঠাৎ করেই শ্যামলা বেগমের নামে বিল বকেয়া সংক্রান্ত বিদ্যুৎ বিভাগের মামলার সমন এসেছে। এতে এলাকায় সাধারণ মানুষের মনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।’ এমন মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে শ্যামলা বেগমসহ ভূক্তভোগি সকলকে হয়রানী বন্ধের দাবি এলাকার সাধারন মানুষের।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ লাইন পাইয়ে দিতে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা গ্রহণকারী মশিউর রহমান বলেন, ‘ওই এলাকায় ৯টি সেচে বিদ্যুৎ লাইন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩টির বিষয়ে আমার জানা নেই। পরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাকি ৩টির ব্যাপারে অফিসকে অবহিত করা হয়। এরমধ্যে দুটিতে নিজ দায়িত্বে খুঁটি এবং তার কিনে সংযোগ নেন। কিন্তু শ্যামলা বেগমের লাইনটি বাতিল হলে অফিসকে অবহিত করা হয়েছিল। যেখানে অফিসকে অবহিত করা হয়েছে সেখানে শ্যামলা বেগমের নামে বিদ্যুৎ বিল আসার কথা না। তার নামে কেন বিদ্যুৎ বিল আসলো এটা বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারাই ভালো জানেন।’
বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলাম বলেন বিদ্যুৎ আফিসের যোগ সাজসে স্থানীয় কিছু লোক সিন্ডিকেট তৈরি করে বিদ্যুৎ সংযোগের নামে শত শত মানুষকে এভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের এমন হয়রানীমূলক মামলা তুলে নেবার দাবি করেন
মামলার বাদী টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী দফতরের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ (বিউবো) এর সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইমুম শিবলীর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে মোবাইলে কথা বলা যাবে না। অফিসে আসেন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ রকম হাজার হাজার মামলা হচ্ছে।’ আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
টাঙ্গাইলের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ (বিউবো)-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাদত আলীর কাছে মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি উল্টো ধমক দিয়ে বলেন, ‘মামলা হয়েছে কিনা আমি কীভাবে বলবো? এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। আমি ফোনে কিছু বলবো না, রাখেন!’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এদিকে এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিসে গেলেও একজনের বেশি সংবাদকর্মী তার কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতিও দেন না।আবার ক্যামেরার সামনেও কথা বলতে রাজি নন তিনি।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply