এম শহিদুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলে নামসর্বস্ব ট্রেড লাইসেন্সেই অবাধে বিক্রি হচ্ছে অনুমোদনহীন কারখানার ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার নামের বিশুদ্ধ পানি। এ ধরনের কারখানা নির্মাণে মানা হয়নি কোনো রকমের বিধিমালা। এসব কারখানা নির্মাণে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদনসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রিমিসেস সার্টিফিকেট, শ্রমিকদের শারীরিক সুস্থতার সনদ, পরিবেশগত ছাড়পত্র ও কল-কারখানার সনদের বিধান থাকলেও এর একটিও নেই। কারখানাগুলোর নিজস্ব ল্যাব বা কেমিস্ট নেই।
এসব বিধিবিধান অমান্য করেই জেলা শহরে অবাধে বিক্রি হচ্ছে অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) এবং মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার নামের দুটি কারখানার পানি।
সম্প্রতি শহরের শামসুর রহমান খান মার্কেটের টাইম গার্মেন্টস নামের একটি দোকানে দেয়া অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানার নিউ জমজম পানির ২০ লিটার বোতলজারে পাওয়া যায় পোকা। পরে বিষয়টি কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের।
নিউ জমজম পানির জারে পোকা পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন টাইম গার্মেন্টসের মালিক সোহাগ। তিনি বলেন, পরবর্তীতে পানি সরবরাহে এমন ত্রুটি থাকবে না শর্তে পানি ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সমাধান করেন।
ওই মার্কেটের সামরহিল গার্মেন্টেসের মালিক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আগে তিনি কারখানায় নিউ জমজমের পানি রাখতেন। পানিতে পোকা পাওয়ার পর থেকে তিনি আর এই কোম্পানির পানি রাখছেন না।’
ব্যাং গার্মেন্টসের মালিক জিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিনি প্রায় তিন বছর অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানার নিউ জমজম পানি ব্যবহার করছেন। ওই কারখানার পানি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল বলেও শুনেছেন তিনি।’
টাঙ্গাইল জেলা নির্মাণ প্রকৌশল শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয়ের অফিস সহকারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানার পানি খাওয়ার কাজে ব্যবহার করছি। মাসে জার পানি লাগে ১০-১৫টি। যার প্রতিটির মূল্য ৪০ টাকা।’
কয়েকজন জার পানির ক্রেতা জানান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে খাবার পানির প্রয়োজন হয়। যা বাসা-বাড়ি থেকে এনে ব্যবহার সম্ভব হয় না। এছাড়া বাইরে থেকে টিউবওয়েলের পানি বারবার আনা কষ্টকর। এ কারণে বিশুদ্ধ পানি ভেবে জার পানি রাখছেন তারা। তবে ক্রয়কৃত স্থানীয় ওই পানি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ সেটি তারা জানেন না।
শহরে জার পানি সরবরাহ করছিলেন মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানার মার্কেটিং ম্যানেজার নয়ন। তিনি জানান, তাদের কারখানা থেকে মাসে প্রায় দেড় হাজার জার পানি বিক্রি করা হয়। যার বাজারমূল্য ৬০ হাজার টাকা। ভোরে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় দিনের বেলায় কারখানা বন্ধ থাকে বলেও তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছর ধরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদনসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রিমিসেস সার্টিফিকেট, শ্রমিকদের শারীরিক সুস্থতার সনদ, পরিবেশগত ছাড়পত্র ও কল-কারখানার সনদ ছাড়াই পানি উৎপাদন আর বিপণন কাজ চালিয়ে আসছে অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) ও মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার ফ্যাক্টরিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তবে নিয়মনীতি মেনে চললেও লোকবল সংকটে বন্ধ হয়ে যায় একই সময় চালু হওয়া জেমস, রিয়া, শান্তি প্লাস ও মক্কা নামের চারটি ড্রিংকিং ওয়াটার ফ্যাক্টরি।
তবে এখনো উৎপাদন ও বিপণন চালিয়ে আসছে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নে নির্মিত জমজম ড্রিংকিং ওয়াটার (নাম পরিবর্তন করে অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার) এবং করটিয়া ইউনিয়নের ক্ষুদিরামপুর এলাকার মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার নামের দুটি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি বাজারজাত করছে ২০ লিটারের জার পানি। এরমধ্যে অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) পানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইন্সেস আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের ট্রেড মার্ক রেজিস্ট্রেশনের আবেদন বাদে অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আবেদন নেই। তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন স্যানিটারি কর্মকর্তা ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকের স্বাক্ষরযুক্ত আবেদন পাওয়া গেছে। এগুলো দিয়েই জার পানি সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহরব্যাপী কয়েকটি গাড়িতে সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে অবৈধভাবে পরিচালিত ড্রিংকিং ওয়াটার কোম্পানি দুটির পানি। ২০ লিটার পানির প্রতিটি জার বোতল ৪০-৫০টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে এ দুই পানি কোম্পানির দৈনিক বিক্রি প্রায় পাঁচ শতাধিক বোতল। তবে এর ক্ষতিকর দিকগুলো না জেনে বিশ্বাস করে এবং প্রয়োজনের তাগিদে পানিগুলো ব্যবহার হচ্ছে জেলা শহরের বিভিন্ন ব্যাংক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দফতরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া একাধিক পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক জানান, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার না থাকায় এ ধরনের জার পানি সর্বোচ্চ তিন দিন ব্যবহার করা সম্ভব। তবে জারের মুখ বেশিদিন খোলা থাকলে পানিতে মশা ডিম পাড়াসহ জন্ম নিতে পারে নানা ধরনের পোকা, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। পানিতে সৃষ্টি হতে পারে দুর্গন্ধও।
সরেজমিন অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) কারখানা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে আটজন শ্রমিক কর্মরত থাকলেও একজন শ্রমিক করছেন বোতল ধোয়া আর পানি ভর্তির কাজ। তবে এ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের হাতে ছিল না গ্লাভস ও শরীরে অ্যাপ্রোন। পায়ে ছিল স্যান্ডেল। যা পানি ফ্যাক্টরি নীতিমালাবর্হিভূত।
বোতল পরিষ্কার বা ধোয়ার কাজে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবহার হচ্ছে পানি। এছাড়া অটোমেটিক ফিলিং মেশিনে পানি বোতলজাত করার বিধান থাকলেও এখানে সরাসরি মাটির অগভীর থেকে মোটরে তোলা পানি খোলা কলের মাধ্যমে ভরে বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পানি ভর্তি জারে হাতের সাহায্যে প্লাস্টিক মুখ লাগানোসহ স্কচটেপ পেঁচাতে দেখা গেছে।
তবে সদর উপজেলার করটিয়া ইউনিয়নের ক্ষুদিরামপুর থেকে পরিচালিত মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানাটি দিনের বেলায় বন্ধ থাকায় এর কার্যক্রম সরেজমিন দেখা যায়নি। তবে শহরব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির পানি সরবরাহ চলমান রয়েছে।
ক্যামেরায় বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফোনে পানির জারে পোকা আর জরিমানা দেয়ার কথা স্বীকার করেন অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) কারখানার কর্তৃপক্ষ কামাল পাশা। তিনি বলেন, ‘ক্রেতার ব্যবহারজনিত সমস্যায় পানির বোতলে পোকা প্রবেশ করেছিল। শুধু ব্যবসায়িক ভাবনায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা দেয়া হয়েছিল।’
তিনি দাবি করেন, তাদের পরিচালিত কারখানার ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দফতরে আবেদন করার প্রক্রিয়া চলছে। দাফতরিক অনুমতি ব্যতীত ব্যবসা পরিচালনা ঠিক কি-না এমন প্রশ্নে কারখানাটির কর্তৃপক্ষ বলেন, মার্কেট ধরতে তারা বাজারে পানি সরবরাহ করছেন।
বিএসটিআইয়ের টাঙ্গাইল ফিল্ড অফিসার সিকান্দার মাহমুদ বলেন, ‘ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহের জন্য প্রয়োজন বিএসটিআই, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আইসিডিডিআরবির অনুমোদনসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রিমিসেস সার্টিফিকেট, শ্রমিকদের শারীরিক সুস্থতা সনদ, পরিবেশের ছাড়পত্র ও কল-কারখানার সনদ। সকল সনদপ্রাপ্ত হওয়ার পরে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পায় বিএসটিআইয়ের সনদ। এরপরই পানি কোম্পানিগুলো করতে পারে উৎপাদন আর বিপণন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকবে হবে ওয়াটার পিউরিফাইয়ার মেশিন। ফ্যাক্টরিতে কোনো প্রকার হাতের ছোঁয়া ছাড়াই অটোমেটিক ফিলিং মেশিন বা ম্যানুয়াল মেশিন দ্বারা পানি বের করার নিয়ম রয়েছে। রয়েছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে বোতল পরিষ্কার বা ধোয়ার বিধান। এসব পানি উৎপাদন ও বিপণন দণ্ডনীয় অপরাধ।’
টাঙ্গাইলের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘এ ধরনের পানি বেশিরভাগই অপরিশোধিত ও নিরাপদ নয়। এ পানি ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ যেমন- টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ভাইরাস, ডায়রিয়া, কলেরার ঝুঁকি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের পানির মধ্যে প্লেগ ও আরসেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতু থাকতে পারে। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন এ ধরনের পানি ব্যবহারে ত্বক, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে। রয়েছে ক্যান্সার তৈরির ঝুঁকি।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ টাঙ্গাইল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল আলম রিজভী এ বিষয়ে বলেন, বিএসটিআইয়ের সনদ ছাড়া পানি উৎপাদন ও বিপণন অবৈধ। অবৈধভাবে পরিচালিত ফ্যাক্টরিগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
টাঙ্গাইল কল-কারাখানা অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হোসেন জানান, টাঙ্গাইলে পরিচালিত অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) ও মেঘ ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার নামের দুটি ফ্যাক্টরি তাদের সনদপ্রাপ্ত নয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠান দুটিতে কয়জন আর কোন কোন বয়সের শ্রমিক কাজ করছেন সেটিও তারা অবগত নন।
পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটি পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এ ধরনের পানি উৎপাদন ও বিপণনকারী ফ্যাক্টরিগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী বশির আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ জেলার পানিতে আয়রনের পরিমাণ অনেক বেশি। আয়রনমুক্ত পানি পেতে ন্যূনতম ৪০০ ফুট গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হয়। পানি উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরিগুলো কতটা গভীর থেকে পানি উত্তোলন করছে সে বিষয়টি জরুরি। তবে অপ্সরা ড্রিংকিং ওয়াটার (নিউ জমজম) ফ্যাক্টরির পানি বুয়েট কর্তৃক নিরীক্ষা রিপোর্টে কলিফরম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। যা মানবদেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।’
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply