দুসস ডেস্কঃ পবিত্র আল কোরআনের ঘটনার মাধ্যমে মূর্তিপূজার বিপক্ষে বলা হয়েছে। যেমন, সূরা আল আম্বিয়া : ‘যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলল, এই মূর্তিগুলো কী, যার পূজায় তোমরা রত রয়েছ!’ সে বলল :’তোমরা নিজেরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরাও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।’ (আয়াত-৫২-৫৪) অথবা সূরা আল আরাফ : ‘তখন তারা এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছালো, যারা স্বহস্ত নির্মিত মূর্তিপূজায় নিয়োজিত ছিল। তারা বলতে লাগল, হে মুসা, আমাদের উপাসনার জন্যও তাদের মূর্তির মতোই একটি মূর্তি নির্মাণ করে দিন।’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে বড়ই অজ্ঞতা রয়েছে।’ (আয়াত-১৩৮)
এই সূরার ১৩৯ থেকে পরবর্তী আয়াতগুলো পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায়, হজরত মুসার (আ.)এর সম্প্রদায় গরুর মূর্তি তৈরি করে তার পূজা করলে ওই পূজার বিষয়ে মহান আল্লাহ হজরত মুসার (আ.)এর সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছেন। এখানে শুধু পূজা ছাড়া শুধু মূর্তি বা ভাস্কর্য নিষিদ্ধ তা বলা হয়নি। অবশ্যই সূরা হজের ৩০নং আয়াতের বাংলা অনুবাদ :’তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথন থেকে দূরে সরে থাক’ পড়লে মনে হতে পারে মূর্তিপূজা নয়, মূর্তিও বর্জনীয়। কিন্তু ওই আয়াতের পূর্বের ও পরের আয়াতগুলো পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাবে, মূর্তিদের বলতে এখানে ওই মূর্তিদের কথা বলা হয়েছে, যাদের পূজা করা হয় এবং আল্লাহ তার সঙ্গে ওই মূর্তিদের শরিক করতে নিষেধ করেছেন।
ওই মূর্তিদের বলতে এখানে ভাস্কর্য বোঝানো হয়নি। আর সেই কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান ওই আয়াতের অনুবাদ করেছেন : ‘তোমরা বর্জন কর মূর্তিপূজার অপবিত্রতা…’ [তাফসির ইবনে কাসীর, চতুদর্শ খণ্ড, ঢাকা : তাফসির পাবলিকেশন কমিটি, ২০০৫), পৃ. ৪৫৩]। অন্যদিকে ভাস্কর্য নির্মাণের যে অনুমতি ইসলামে রয়েছে তা আল কোরআনের সূরা সাবার ১৩নং আয়াত পড়লে স্পষ্টত্ব বোঝা যায়। ওই আয়াতে বলা হয়েছে :’তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য (ওয়াতামাছিল), হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুলি্লর ওপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার, কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।’ (http://www.quran.gov.bd) এবং রহমান, তাফসির ইবনে কাসীর, খণ্ড : ১৬, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২)।
এই আয়াত থেকে ভাস্কর্য ইসলামে বৈধ এবং মূর্তিপূজা অবৈধ তা স্পষ্ট। কারণ মহান আল্লাহ পূর্বের আয়াতগুলোয় মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করলেও এই আয়াতে নিজেই কৃতজ্ঞতা সহকারে দুর্গ, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুলি্লর ওপর স্থাপিত বিশাল ডেগের পাশাপাশি ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ অব্যাহত রাখতে বলেছেন।
প্রশ্ন হতে পারে, মহান আল্লাহ ভাস্কর্য নির্মাণ অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে আমরা ভাস্কর্য নিষিদ্ধ এ কথা বলার কে! সাধারণ জ্ঞান বলে নবী সুলাইমান (আ.) নিশ্চয় পূজা করার জন্য কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করবেন না। আর সেই ভাস্কর্যকে আল্লাহর স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নও আসে না। সুতরাং এই ভাস্কর্য যে পূজার জন্য নির্মিত হয়নি তা স্পষ্ট)। হজরত সুলাইমান (আ.) ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন, সেটি মহান আল্লাহ আল কোরআনে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হজরত মুসা অথবা ইব্রাহিমের (আ.) ক্ষেত্রে যে মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল, তা উপাসনার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল বলে মহান আল্লাহ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং ওইগুলো পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু হজরত সুলাইমানের (আ.) ভাস্কর্য পূজার জন্য নির্মিত হয়নি বলে আল্লাহ ওই ভাস্কর্য নির্মাণকে আল কোরআনে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বস্তুত আল কোরআনে ভাস্কর্য বিষয়ে দুই ধরনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, যদি ভাস্কর্য উপাসনার জন্য নির্মিত হয় অথবা উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা অবশ্য নিষিদ্ধ। কারণ তখন সেটি অবশ্যই আর ভাস্কর্য থাকে না। দেব-দেবীর মূর্তিতে পরিণত হয়। আর যদি হজরত সুলাইমানের (আ.) মতো সৌন্দর্যের জন্য নির্মিত হয়, তাহলে সেটি মূর্তি নয়, ভাস্কর্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
অনেকে হয়তো খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন, হজরত সুলাইমানের (আ.) সময় অনুমতি ছিল; হজরত মুহাম্মদের (সা.) সময় তা বৈধ নয়। তাদের এ ধরনের বক্তব্য আল কোরআনের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কারণ আল কোরআনের প্রায় অধিকাংশ অংশজুড়ে প্রাচীন ইতিহাস, নবীদের সময়ের দৃষ্টান্ত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং ওই আলোচনার মাধ্যমে মুসলিমদের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। আমরা যদি এভাবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে আল কোরআনে বর্ণিত নবীদের সময়ের ঘটনা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলতে থাকি, তাহলে ইসলামের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। কারণ ইসলাম মহানবী (সা.) প্রবর্তিত ধর্ম নয়। হজরত আদম (আ.) ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তী সময়ে নানা জাতি-জনপথে আগমনকারী নবীদের মাধ্যমে তা বিকশিত হয়ে সর্বশেষ হজরত মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে তা পরিপূর্ণতা পায়। তাই পূর্ববর্তী নবীদের সময়ের ঘটনাগুলো আমাদের অনুসরণীয়। ওই ঘটনাগুলো থেকে ইতিবাচক দিক গ্রহণ করতে হবে এবং নেতিবাচক দিক বর্জন করতে হবে।
আল কোরআনে মূর্তিপূজার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অনেকে বলেন, যদি ভাস্কর্য তৈরি করা হয় তাহলে মুসলিমরা মূর্তিপূজায় ফিরে যেতে পারে; যেমন গিয়েছিল হজরত মুসার (আ.) সম্প্রদায়। তাদের জন্য বলছি, সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ মহানবী (সা.) সর্বশেষ নবী। এরপর আর কোনো নবী আসবেন না। পূর্ববর্তীর নবীর উম্মতরা মূর্তিপূজায় ফিরে গিয়েছিল। কারণ আল্লাহর প্রেরিত বাণী হারিয়ে বিকৃত হয়েছিল। যার উদাহরণ ইঞ্জিল অথবা তাওরাত। এই ধর্মগ্রন্থ অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান নেই। কিন্তু আল কোরআনের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা নেই। কারণ সূরা হিজরে আল্লাহ নিজেই আল কোরআন তথা ইসলাম ধর্মের হেফাজত করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তাই কেয়ামত পর্যন্ত ইসলাম কখনও বিলুপ্ত হবে না। আর ভাস্কর্য নির্মাণ করলে যদি মুসলিমরা মূর্তিপূজায় ফিরে যেত, তাহলে ইরানে বছরের পর বছর বিদ্যমান থাকা ভাস্কর্যের প্রভাবে ইরানে একজনও মুসলিমের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। অন্যদিকে মহানবীর (সা.) অবস্থান শুধু মূর্তিপূজার বিপক্ষে ছিল না। তিনি আগুন, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গাছ, কুয়া প্রভৃতি যে প্রকৃত আল্লাহ নয় অথবা এর মাধ্যমে প্রকৃত আল্লাহর ইবাদত সম্ভব নয় তা বলেছেন। এ ছাড়া তিনি খ্রিস্টানদের ত্রিত্ব ধারণা বাতিল করে দিয়ে হজরত ঈসা (আ.) ও মরিয়মকে (আ.) আল্লাহর পুত্র-কন্যা নয় বলে ঘোষণা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের অবস্থান ভাস্কর্য নয়, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো এক সত্তা বা একাধিক সত্তাকে সৃষ্টিকর্তা মনে করে পূজা করা অথবা আল্লাহ ‘র সঙ্গে যে কোনো কিছুরই অংশীদারি করার বিপক্ষে। এমনকি যদি কেউ আল্লাহকে বিশ্বাস করেন এবং বলেন, আল্লাহ একাধিক জন, সেটাও ইসলাম অনুমোদন করে না।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ভাস্কর্য থাকলে মুসলিমরা আবার মূর্তিপূজায় ফেরত যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এর ধ্বংস প্রয়োজন। তাহলে পৃথিবীতে আগুন, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গাছ, কুয়া প্রভৃতির ক্ষেত্রে কী হবে? মানুষ এক সময় ওইগুলোর পূজা করত। ওইগুলোর যদি অস্তিত্ব থাকে তাহলে মানুষের তো আবার ওইগুলোর পূজায় ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে! প্রকৃতপক্ষে, ভাস্কর্য সম্পর্কিত অবৈজ্ঞানিক ও অলস মস্তিষ্কপ্রসূত বক্তব্য চর্চা করতে গেলে পুরো পৃথিবীকেই ধ্বংস করতে হবে। কারণ ইতিহাস চর্চা করলে দেখা যাবে, মানুষ এক সময় নভোমণ্ডলের দৃশ্যমান-দৃশ্যমান প্রায় সব প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্টি অতিপ্রাকৃতিক বস্তুকে সৃষ্টিকর্তা মনে করে পূজা করেছে। মানুষ আবার পূজায় ফিরে যাবে ওই আশঙ্কায় ওই সব পূজনীয় বস্তুর সব ধ্বংস করা কি আদৌ সম্ভব?
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে মহানবীর (সা.) কাবাঘরের মূর্তি অপসারণ করলেন কেন? মনে রাখতে হবে, কাবাঘরে কোনো ভাস্কর্য ছিল না। ছিল মূর্তিপূজার উপাস্য বা প্রতিমা। আর ইসলাম প্রতিমার ওই সৃষ্টিকর্তা হওয়ার দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে বলেই মহানবী (সা.) তা কাবাঘর থেকে অপসারণ করেছিলেন। অবশ্যই কাবাঘর ছাড়া অন্য কোনো জায়গা থেকে মহানবী (সা.) প্রতিমা অপসারণের নির্দেশ দেননি বা অপসারণ করেননি। শুধু কাবাঘর থেকে প্রতিমাগুলো অপসারণ করেছিলেন। কারণ, কাবাঘর ছিল ইসলাম ধর্মের প্রার্থনাস্থল বা মসজিদ। তাই কাবাঘরের অজুহাত তুলে অন্য ধর্মের মন্দির দখল অথবা ভাস্কর্য ভাঙার সুযোগ নেই।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply