চলমান শুদ্ধি অভিযানে ‘দুর্বৃত্তায়নের পতন’ দেখে ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল থেকে সব পর্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী ও দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত খুশি। তবে এ অভিযানে একই সঙ্গে সমালোচিত দুর্নীতির ‘রাঘববোয়ালদের পতনও তারা দেখতে চান। সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা মনে করেন, শুদ্ধি অভিযানে ‘অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ যেমন, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশও এই অভিযান চলমান রাখার পক্ষে। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুপ্রবেশকারীরা দলে স্থান পেয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার পক্ষে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের কর্মী।
ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক কর্মীরা শুরুতে দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের সুযোগ পেয়ে রাতরাতি হয়ে যান ক্ষমতাধর। এদিকে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীরা আধিপত্য বজায় রাখতে, ব্যবসা পাওয়ার লোভে বণিক শ্রেণী- এভাবে ‘আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে’ প্রায় সব পেশার লোকজন আওয়ামী লীগে প্রবেশের সুযোগ খুঁজতে থাকে। তাদের অনেকেই আগে ভিন্ন দলের সমর্থক ছিল। তাদের প্রায় সবাই দলের প্রভাবশালী নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ক্ষমতাসীন দলে জায়গা করে নেয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটি নতুন নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘কাউয়া’, ‘হাইব্রিড’, ‘অতিথি পাখি সহ অনেক বিশেষণ। সম্প্রতি ‘চাঁদাবজি’, ‘টেন্ডারবাজি’, ‘ক্যাসিনো’ ও ‘জুয়ার ব্যবসা’ সংক্রান্ত পৃথক কয়েকটি অভিযোগে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন স্তরের নেতার জড়িত থাকার ঘটনা প্রকাশ পায়। তাদের কারও অতীত আবার বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রায়ই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলেও অনুপ্রবেশকারীদের দলে ঢুকতে যারা সুযোগ করে দিয়েছেন, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। কারণ অনুপ্রবেশকারীদের পৃষ্ঠপোষকদেরও পৃষ্ঠপোষক রয়েছে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দল ক্ষমতায় আসার পর ‘চাটুকার’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘পারিবারিক’ সমর্থনপুষ্ট নেতারা ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন। আর ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ তাদের কর্মী-সমর্থকদের পকেট ভারী হচ্ছে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, ত্যাগী কর্মীদের তুলনামূলক মূল্যায়ন হয়নি। তাই চলমান ‘দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান’-এ বেশিরভাগ কর্মীরই সমর্থন রয়েছে। তাদের মতে, এই অভিযান জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ¦ল করছে।
এদিকে বিভিন্ন পেশার মানুষ সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ‘রাঘববোয়াল’দের আইনের আওতায় আনার প্রত্যাশা জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা সম্প্রতি বলেন, ‘ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসা’য় যারা জড়িত, তাদের কেউ আওয়ামী লীগের নন। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা সম্প্রতি ‘চাঁদাবজি’, ‘টেন্ডারবাজি’, ‘ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসা’য় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজনকে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী বলে মন্তব্য করেছেন। সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘জিকে শামীম’ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, আগে কে কোন দল করেছে, সেটি বড় কথা নয়। এখন তার পরিচয় সে আওয়ামী লীগ। তাদের যারা দলে স্থান দিয়েছে, তাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, যারা ভিন্ন মতাদর্শের, ভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করেছে, তাদেরও শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। চলমান অভিযান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, দুর্নীতি করে কেউ ছাড় পাবে না। শুদ্ধি অভিযান চলবে।
এর আগে দীঘদিন যাবৎ বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, বৈঠকের বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের এসব ‘অনুপ্রবেশকরী’দের বিষয়ে সবাইকে বারবার সতর্ক করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও ভিন্ন মতাদর্শের লোকজন নিয়ে দল ভারী করার বিপক্ষে। তবে বিভিন্ন স্তরে যেসব দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কমিটি দিয়েছেন, তারা বিষয়টি আমলে নেননি।
আওয়ামী লীগে ব্যাপক অনুপ্রবেশ শুরু হয় নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ জয় পায় এবং বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবি হয়। এর আগে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টানা দুই বছরের দমন-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে দেশের বেশিরভাগ দলের রাজনীতিক ও তাদের কর্মী-সমর্থক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
পঁচাত্তরের পর নবম সংসদে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের বিচার শুরু করে আওয়ামী লীগ। অভিযুক্ত হয়ে একে একে বিচারের আওতায় আসতে থাকেন জামায়াত-বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যৎ অনুধাবন করে বিএনপি-জামায়াতের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব স্তরের নেতাকর্মী আঁতকে ওঠেন। অনুপ্রবেশের সুযোগ নিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে আঁতাত শুরু করেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে সংবাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য এবং স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্য, জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরাও রয়েছেন। এসব ‘বসন্তের কোকিল’কে দলে ভিড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের জনবিচ্ছিন্ন একশ্রেণীর নেতা স্থানীয় পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে চাইছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াত থেকে ব্যাপক সংখ্যক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া শুরু করে। ২০১৭ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। স্থানীয় শীর্ষ নেতা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের আশীর্বাদে ক্ষমতাসীন দলে ঠাঁই পান তারা। দল ভারী করতে তাদের এই যোগদানকে শুরুতে ইতিবাচক মনে করলেও পরে নেতবাচক হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা এই ‘অনুপ্রবেশ’ গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন। তাদের কারণেই ত্যাগী ও দীর্ঘ সময় দলকে সেবা দেয়া নেতারা বঞ্চিত হচ্ছেন দলীয় পদ-পদবী থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতি অনেক স্থানেই ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
চলমান শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ব্যাপক সমালোচিত ‘জিকে শামীম’-এর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি। কেন্দ্রীয় যুবলীগ বলছে জিকে শামীম যুবলীগ নয়, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা। তবে এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে দলের উপদফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া গণমাধ্যমকে জানান, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া জিকে শামীম নারায়ণগঞ্জ জেলা কিংবা মহানগরের নেতা বা কর্মী- এ বিষয়ে কোন দলিল নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এ বিষয়ে সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে’ কিংবা ‘আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী কোন সংগঠনের সদস্য হলে’ আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এরপরও দলের বিভিন্ন স্তরে অনুপ্রবেশ ঘটছে। তবে অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্তকরণে কাজ চলছে। বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের কোন সদস্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের পরিবারের সদস্যরা যাতে আর আওয়ামী লীগের সদস্য হতে না পারে বা কোন কমিটিতে ঢুকতে না পারে, এদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এর আগে যেসব স্থানে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে, তা প্রকাশ করতে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তথ্য পেলে কেন্দ্র থেকে ব্যবস্থা নেব।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply