দুসস ডেস্কঃ বহুমাত্রিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশের রাষ্ট্রীয় একমাত্র বীমা প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা শুধুমাত্র দুপুরের খাবার বাবত বিল তুলে নিয়েছেন ৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রাপ্যের চেয়েও দেড়শ কোটি টাকা বেশি। শুধু তাই নয়, গ্রাহকের প্রিমিয়াম ও লভ্যাংশের কয়েক কোটি টাকা জমা না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এভাবে দুই বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৬ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের ওপর বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) তৈরি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে আত্মসাৎকৃত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান জাতীয় বেতন কাঠামো অনুযায়ী একাদশ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরাই শুধু দুপুরের খাবারের জন্য ভাতা পান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা দুই অর্থবছরে লাঞ্চ ভাতা নিয়েছে ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা নিরীক্ষা দলকে জানিয়েছে, দুপুরের খাবার ভাতা দেয়ার ক্ষেত্রে ‘কর্মচারী’ বলতে ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারী’ উভয়কেই বোঝানো হয়। ভাতা প্রদানে সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেরও অনুমোদনুু রয়েছে। তবে নিরীক্ষক দল প্রতিবেদনে এ ব্যয় বন্ধ এবং দুপুরের খাবারের ভাতা গ্রহণকারীদের কাছে টাকা আদায়ের সুপারিশ করেছেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন মতে, করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় ও সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা দুই অর্থবছরে প্রিমিয়াম ও বীমাপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে ১২ জন বীমা গ্রাহকের প্রিমিয়ামের ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা একাই আত্মসাৎ করেন অবসরপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক বি কে বৈদ্য। এ ছাড়া উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. তাকভীর হোসেন ওরফে সবুজ ৭ লাখ ৮ হাজার, সিলেটের উপব্যবস্থাপক খন্দকার এএইচএম হাবিবুল্লাহ ২ লাখ ১৪ হাজার এবং আরেক উপব্যবস্থাপক সালেহ আহমেদ ১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করলেও আত্মসাৎকারীদের কাছ থেকে ওই টাকা আদায় করতে পারেনি। তবে অর্থ আদায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় এবং যথাযথ তদারকির অভাবে একই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইন্সু্যুরেন্স করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুযায়ী লভ্যাংশের ৫ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার কথা থাকলেও। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ২২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা জমা দেয়নি।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে জীবন বীমা করপোরেশন আইন কানুনের তোয়াক্কা করেনি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশ ও নবায়নকৃত প্রিমিয়াম আয়ের ১২ শতাংশের বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা যাবে না। বিদ্যমান বীমা আইনেও একই কথা বলা রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম আয় ছিল ১০৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যার ৯০ শতাংশ ৯৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। একই সময়ে নবায়নকৃত প্রিমিয়াম আয় ছিল ৩৬০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যার ১২ শতাংশ হলো ৪৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সে হিসেবে অনুমোদিত ব্যয় ১৪০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করেছে ২২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ বেশি ব্যয় করেছে ৭৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ৭৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় করেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২০১৩ সালে অনুমোদন ছাড়া বোনাস দিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে কর্মকর্তারা দুই অর্থবছরে উৎসাহ বোনাস নিয়েছেন ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিরীক্ষা দলকে জবাব দিয়েছে যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নিষেধাজ্ঞাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নিরীক্ষা দল অবশ্য কর্মচারীদের মাসিক বেতন থেকে কিস্তির মাধ্যমে বোনাসের টাকা কেটে তা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা করতে বলেছে।
বীমা প্রতিষ্ঠানটি বাজেটের চেয়ে ৯৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আইন খরচের ওপর ১৫ শতাংশ ও গাড়ি মেরামতের ওপর ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করের (মূসক) বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা ছাড়াই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং টাকা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply