দুসস ডেস্কঃ বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির উদ্বেগজনক চিত্র নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভেতরে এখনো কমপক্ষে পাঁচটি সক্রিয় চ্যুতি বিদ্যমান, যা যেকোনো সময় মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের ওই বিচ্যুতিগুলো আগের চেয়ে আরো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উপনীত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে নেপাল, ভারতসহ হিমালয় অঞ্চল বড় ধরনের বিচ্যুতিগুলোর বাড়তি আশঙ্কা বেরেই চলছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত যেকোনো ভূমিকম্পের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর সবসময়ই পড়বে। এর ফলে বাংলাদেশ বর্তমানে নিজস্ব অঞ্চলে কিংবা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সৃষ্ট বহুমুখী ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিবলয়ে রয়েছে। কিন্তু এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলায় এখনো দেশে কার্যকর তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এমনকি সতর্কতামূলক প্রস্তুতিও নেই তেমন কিছু।
জাপানের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. সুয়োমেতো নাকাসি বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেহেতু শক্তিশালী ভূমিকম্পপ্রবণ বলয়ের অনেকটা পেটের মধ্যে রয়েছে, তাই বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারেন না। বাংলাদেশে যেসব সক্রিয় বিচ্যুতি বিদ্যমান সেগুলো বাদেই হিমালয় অঞ্চলের বিপজ্জনক বিচ্যুতিগুলো থেকে ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব খুব সহজেই বাংলাদেশের ওপর পড়বে। আর বারবার এমন পরিস্থিতি হতে থাকলে ঝুঁকি আরো বহুগুণ বেড়ে যায়।
জাপানি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের উচিত পারিপার্শ্বিক অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের সুরক্ষায় কার্যকর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, তাতে অন্ততপক্ষে ভূমিকম্পের সময় ও পরে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, প্রস্তুতি হিসেবে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো অপসারণ করা খুবই জরুরি। এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ নগরায়ণপ্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ভবন বা অবকাঠামোগুলোয় ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা তৈরি করতে পারলে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এ এস এম ড. মাকসুদ কামাল বলেছিলেন, মূল হিমালয়ের প্রধান বিচ্যুতিটির সঙ্গে দেশের ভেতরেই এখন কমপক্ষে পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ বিচ্যুতি রয়েছে এবং পাঁচটিই সক্রিয়। এর মধ্যে আগে থেকেই ডাউকি ও মধুপুর বিচ্যুতি বা ফল্ট নিয়ে ব্যাপক আশঙ্কা ছিল ও আছে। বাকি তিনটি চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা বেল্ট ফল্ট, চট্টগ্রাম-রামরী ফল্ট ও সিলেট আসাম ফল্টও সক্রিয় রয়েছে। এর বাইরে আরো ছোটখাটো অনেক বিচ্যুতি থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
নেপালের ভূমিকস্পে বাংলাদেশে যেভাবে কম্পন উপলব্ধি হয়েছিল তাতে পরিস্থিতি আরো বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে, কারণ বারবার এমন ঝাঁকুনিতে ভূতলের প্লেটগুলোর গতি-প্রকৃতি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এই বিশেষজ্ঞ ভূমিকম্প নিয়ে বাংলাদেশে এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির পরিণতি সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ঢাকায় যেভাবে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে, বাড়িঘর-ভবন উঠছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনগুলো বহাল রয়েছে তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেই বিপজ্জনক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতরে না হয়ে পার্শ্ববর্তী কোথাও শক্তিশালী ভূমিকম্প হলেও এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
যুক্তরাজ্যের ভূবিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড রথারি বলেছিলেন, হিমালয়ের পর্বতগুলো ভারতীয় প্লেটের ওপর প্রবলভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। সেখানে দুই থেকে তিনটি বড় ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। আর কিছু মৃদুগতিতে সঞ্চারণশীল বিচ্যুতিও রয়েছে। এসব কারণে এ এলাকায় বেশি ভূমিকম্প হচ্ছে।
একই সূত্রের আরেক বিশ্লেষণে বলা হয়, মধ্য এশীয় টেকটোনিক প্লেটের (ভূত্বকের বিশাল খণ্ড) নিচ দিয়ে ভারতীয় প্লেটগুলো অতি ধীরে ধীরে ঢুকে যাওয়ার ফলে হিমালয় অঞ্চলের পর্বতগুলো তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর দুই ইঞ্চি করে এই প্লেট দুটি পরস্পরের দিকে সরে আসছে। এর ফলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। আর বারবারই এ অঞ্চলে ভূমিকম্প হতে থাকে। ১৯৩৪ সালে বিহারে ৮ দশমিক ১ এবং ২০০৫ সালে কাশ্মীরে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার দুটি ভূমিকম্পে এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এই দুটি ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বলে জানান বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে চীনের বড় ভূমিকম্পেও অনেক সময় বাংলাদেশে ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশের সিডিএমপির (কমপ্রেহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল নেপালের ভূমিকম্পের পরে সে সময়ে রাতে রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের শিলিগুড়িতে। এটির উৎপত্তিগত গভীরতা ছিল ২৯.৪ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গভীরতা যদি কম হতো তবে বাংলাদেশের ওপর অনেক বেশি প্রভাব পড়ত। নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটারের মতো। আর মাত্রাও ছিল ৭.৮ যারফলে তখন নেপালে ঘটেছিল চরম বিপর্যয়। এর প্রভাবে ভারতের কোথাও কোথাও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশেও ৪ জনের মৃত্যুসহ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
নেপালে ভূমিকম্পের আগে বাংলাদেশের শরণখোলায় একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল শনাক্ত হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৬ এবং গভীরতা ছিল ১৯ কিলোমিটার। পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় আরো অনেক ভূমিকম্প হয়েছে, যার সবগুলোরই মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫-এর মধ্যে। এছাড়াও সীমান্তবর্তী এলাকায় আরো অনেক ভূমিকম্প রেকর্ড করা রয়েছে আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থার কাছে, যেগুলো ছিল ৫ থেকে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার। নেপালে ভূমিকম্পে যতবারই নেপাল কেঁপেছে, ততবারই ওই কম্পনের ধকল এসে বাংলাদেশে লেগেছে।
অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, বাংলাদেশ লাগোয়া যেকোনো এলাকায় আবার কোনো কম গভীরতায় বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর বাংলাদেশের ভেতরে সক্রিয় থাকা কোনো বিচ্যুতি থেকে এমন ধরনের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে তা হবে খুবই বিপজ্জনক। আমরা কোনোভাবেই এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি না।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply