দুসস ডেস্কঃ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের তালিকা নিয়ে লেজে-গোবরে অবস্থা করে ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত হবে কবে তা অনিশ্চিত। আর রাজাকারের তালিকাও এবছরেই হচ্ছে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাহজাহান খান বলেন, ‘অনেক অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকে গেছে।’
অন্যদিকে সেক্টর কামন্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, ‘জাতীয়ভাবে পরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামও রাজাকারের তালিকায় ঢোকানো হয়েছিল।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) প্রকাশ করেছিল সরকার।
তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা থেকে জানা গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোট দুই লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জনের নাম বিভিন্ন সময়ে গেজেটভুক্ত হয়েছিল। আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা গত জানুয়ারি মাসে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে মাসিক ভাতা বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে এখনো।
এর আগে ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার, ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকার, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কাজ করে।
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছরেরও আমরা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করতে পারলাম না। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা।’
তিনি বলেন,‘মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক দুঃসময় গেছে বাংলাদেশের। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে ২১-২২ বছর গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক সরকার টানা ১৪-১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এখনো পর্যন্ত তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তা নিয়েও নানা অভিযোগ আছে যা দুঃখজনক।’
তিনি আরো বলেন, ‘এরশাদ ও বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ও তালিকা করা হয়েছে। তখন অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনো তো সেই অভিযোগ আছে।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করে দিয়েছি। কিছু লোক আছে যারা যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে। যারা প্রশ্ন করার তারা করবেই। কবরস্থান পর্যন্ত করবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদেরতো আবেদন করতে হবে। আবেদন না করলে আমি বুঝব কীভাবে? আমার কাছে তো অহী আসবেনা। আমি তো সবাইকে চিনিনা। সবাইতো আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ২০০ লোক। তালিকাতো উপজেলা থেকে এসেছে। আমরা সেটা দেখেছি। এখন সেখান থেকে কোনো অমুক্তিযোদ্ধার নাম পাঠানো হলে আমরা বুঝব কীভাবে?’
মন্ত্রী আরো বলেন,‘এখন আর নতুন করে আবেদনের সুযোগ নাই। যে আবেদন আছে সেগুলো এখনো আমরা যাচাই বাছাই করছি। তালিকা থেকে সংখ্যা কমতে পারে যদি কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয় যে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।’
যাচাই বাছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান শাজাহান খান বলেন,‘মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা সবাই এত আবেদন করেছেন যে একবারের শুনানিতে হচ্ছেনা। একাধিকবার শুনানি করতে হচ্ছে। আমাকে ১৫টি জেলা দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কয়েক হাজার আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পেন্ডিং আছে। আমাদেরতো অন্যান্য কাজও আছে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে নতুন কোনো আবেদনের সুযোগ নেই। পেন্ডিং আবেদনগুলোই যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে সময় লাগবে।’
রাজাকারের তালিকা: জাতীয় সংসদে আইন পাস হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকার, আলবদর, আল শামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করে প্রথম পর্যায় হিসেবে। কিন্তু ওই তালিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে তা স্থগিত করা হয়। ওই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা এমন কী শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নামও ছিলো।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী রবিবার গণমাধ্যমে বলেন, ‘ওই তালিকার সঙ্গে এখন আর আমি যুক্ত নই। এটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান শাজাহান খান কাজ করছেন।’
শাজাহান খান বলেন,‘সারাদেশে ৪৫০টির মতো উপজেলা। আমরা ১৫০টি উপজেলার রাজাকারের তালিকা পেয়েছি। এটা প্রকাশ করলে নানা আলোচনা সমালোচনা হবে। যাই হোক আমরা প্রকাশ করে দিতে পারি। কিন্তু আমরা চাইছি আলোচনা সমালোচনা যাই হোক একবারে হোক। তাই একবারে প্রকাশ করতে চাইছি।’
তিনি আরো বলেন,‘সামনে নির্বাচন আছে। আমরা সেটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই নির্বাচনের আগে আর সারাদেশের তালিকা এক করে প্রকাশ করা সম্ভব হবেনা। আশা করছি নির্বাচনের পরে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করব।’
তবে ১৫০ উপজেলায় কতজন রাজাকার পাওয়া গেছে সেই সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব বলেন,‘মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কয়েক বছর আগে রাজাকারের যে তালিকার নামে যা প্রকাশ করেছিল তা ন্যাক্কারজনক। বহু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যারা জাতীয়ভাবে পরিচিত তাদের রাজাকারের তালিকায় দেখানো হলো। এতটা অক্ষমতা আর অবহেলা নিয়ে আমরা আছি। এটাই বাস্তবতা।’
তিনি আরো বলেন,‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়গুলো নিয়ে শুধু অযোগ্যতা, অদক্ষতা নয়, কোনো কোনো পর্যায়ে সংকট আছে। আমি হয়তো চিহ্নিত করতে পারবো না। তবে নিশ্চয়ই সংকট আছে। তা না হলে এরকম হবে কেন?
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply