দুসস ডেস্কঃ অতঃপর বাতিল হয়ে যেতে পারে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জায়েদা খাতুনের প্রার্থীতা এবং প্রকারান্তরে মেয়র পদ। নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হলে মেয়র অপসারণের বিধান রয়েছে।
আলোচিত সমালোচিত জায়েদা খাতুনের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসা হচ্ছে না। ছেলের কারণেই তিনি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন আলোচনায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না। মনোনয়ন দাখিলে উপযুক্ত তথ্য না দেওয়ায় মেয়র পদ থেকে অপসারিত হতে পারেন জায়েদা খাতুন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত ও পরে পদত্যাগ করা মেয়র, এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত ও পরে সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্ত মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। উপরন্তু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারও হন। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নিজের পরিণতির ব্যাপারে আঁচ করতে পেরে আগেভাগেই নিজের সঙ্গে তার ৭০ বছর বয়সী মা জায়েদা খাতুনকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে দাঁড় করান। কিন্তু সময় ব্যবস্থাপনার হেরফেরে খেলাপি ঋণের কারণে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল হলেও টিকে যান তার মা। জোরকদমে মায়ের নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা শুরু করেন জাহাঙ্গীর আলম। শুধু তাই নয়। জাহাঙ্গীর আলম এমনভাবে মাকে নিয়ে প্রচার প্রচারণা করেন তাতে লোকজন বুঝতে শুরু করেন যে জায়েদা খাতুন একজন ডামি প্রার্থী ছাড়া আর কিছুই নয়! মাকে তিনি রোবটের মত সুইচ টিপে পরিচালিত করতে থাকেন। নির্বাচনের আগে ও পরে জাহাঙ্গীর আলম লাইমলাইটে থাকেন, আর মাকে রাখেন অনেকটা আড়ালে। যেন নির্বাচনটা জাহাঙ্গীর আলমের নিজের। তেমনটিই বলেছেন গণমাধ্যমে “জিতলে মা প্রশাসনিক প্রধান হবেন, আমি থাকব সহযোগিতায়: জাহাঙ্গীর”
নির্বাচন আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করে নির্বাচনী পোষ্টার ও লিফলেটে মায়ের সঙ্গে নিজের ছবি ছেপে ওই লিফলেট নিয়ে মডেলিং করে পোজ দিয়ে ছবি তুলে প্রচার প্রচারণা চালান। সেই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে নির্বাচন কমিশন শোকজ করেন জায়েদা খfতুনকে।
জাহাঙ্গীর আলম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং খোদ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা, এবং একজন আইনের সেবক আইনজীবী, এবং একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি হওয়ায় জোর করেই কি নির্বাচন আচরণ বিধিমালা ভঙ্গ করলেন? নগরবাসী ঠিকই বুঝতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়।
নির্বাচন আচরণ বিধিমালা জানতেন না এবং ভক্তরা ওইসব পোষ্টার ও লিফলেট ছেপেছে বলে নির্বাচন কমিশনে শোকজের জবাব দিয়ে ওই যাত্রায় রক্ষা পান।
আনুষ্ঠানিকভাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো সম্পর্কই ছিল না জাহাঙ্গীর আলমের; তবু রাজধানীর পাশের এই গুরুত্বপূর্ণ নগরীর নির্বাচনে তিনি হয়ে উঠেন গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। নির্বাচনের শুরু থেকেই জাহাঙ্গীর আলম “আমাকে গুম করতে পারে”, “আমাকে খুন করতে পারে” ইত্যাদি বার বার বলে ভোটের উৎসবে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভয়ের আবহ তৈরী করেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের জন্য ইসিকে প্রভাবিত করতে কূটনীতিকদের কাছে চিঠি পাঠান স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের কাছে লেখা ওই চিঠিতে মা-ছেলে মিলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেন।
ভোটের দিন ফলাফল ঘোষণার প্রাক্কালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটের ফলাফল আটকে রাখার অভিযোগ তুলেন জাহাঙ্গীর আলম। ২৫ মে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে এসে মেয়রপ্রার্থী মা জায়েদা খাতুনের পক্ষে তিনি এ অভিযোগ করেন। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ফলাফল নিয়ে যদি ছিনিমিনি খেলা হয় তাহলে আমরা মানব না। আমি গাজীপুরের গার্মেন্টস মালিক, কর্মী ও জনগণকে বলব, যদি ছিনিমিনি হয় তাহলে আপনারা প্রতিবাদ করবেন।’
এমন নানা কারসাজি করে তার মা জায়েদা খাতুনকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিজয়ীও করেন। কিন্তু গোড়ায়ই রয়েযায় গলদ। জায়েদা খাতুন নির্বাচনী হলফনামায় ১ নম্বর শর্তই পূরণ করতে ব্যার্থ হন!
হলফনামায় উল্লেখ অংশে, আমি শপথপূর্বক ঘোষণা করিতেছি যে, ১। আমার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা (উত্তীর্ণ পরীক্ষার নাম) সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি এতদ্সঙ্গে যুক্ত করিলাম। কিন্তু জায়েদা খাতুন উত্তীর্ণ পরীক্ষার নামের স্থলে উল্লেখ করেছেন ‘স্বশিক্ষিত’। সুতরাং তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপিও যুক্ত করেননি।
এতেই বাতিল হয়ে যেতে পারে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জায়েদা খাতুনের প্রার্থীতা এবং প্রকারান্তরে মেয়র পদ। নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হলে মেয়র অপসারণের বিধান রয়েছে।
নগরবাসীরা উত্তর খুঁজছেন, ‘স্বশিক্ষিত’ ডিগ্রি কোথায় পড়ানো হয়? তার সার্টিফিকেট দেখতেই বা কেমন? ‘স্বশিক্ষিত’ ডিগ্রিই কি সিটি করপোরেশন পরিচালনা করার জন্য অপরিহার্য?
হলফনামায় জায়েদার পেশা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে ‘ব্যবসা’, যা থেকে বছরে আয় দেখানো হয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদ হিসাবে নগদ অর্থ দেখিয়েছেন ৩৫ লাখ টাকা। ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। অনারেবল টেক্সটাইল কম্পোজিট লিমিটেডে শেয়ারমূল্য দেখিয়েছেন দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা।
স্বর্ণালংকার দেখানো হয়েছে ৩০ তোলা। ইলেকট্রনিকসামগ্রী এক লাখ ৫০ হাজার টাকার, আসবাবপত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকার। স্থাবর সম্পদ কিংবা কোনো ঋণের কথা উল্লেখ নেই হলফনামায়।
জায়েদা খাতুনের নির্বাচনী হলফনামার সঙ্গে দাখিল করা ২০২২-২০২৩ কর বর্ষের আয়কর রিটার্নে দেখা যায় তিনি ব্যবসার পুঁজি (মূলধনের জের) হিসেবে দেখিয়েছেন চার কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এই টাকা তিনি কোথায় রেখেছেন বা কোথায় বিনিয়োগ করা আছে বা কোথায় কী ব্যবসা চলে তা জায়েদা খাতুন তার নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেননি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘোষিত ফলাফলে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত জায়েদা খাতুনের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি জাহাঙ্গীর আলমের মা। মনোনয়নপত্র দাখিল করার আগে জায়েদা খাতুনকে রাজনীতির মাঠে এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানেও দেখা যায়নি।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply