মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতঃ ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ভারতের ইতিহাসে এক দুর্যোগের ঘনঘটা। দিল্লিতে নিজের বাসঘরেই বসে ছিলাম। হঠাৎ যেন একটা ভূকম্পন হয়ে গেল। ঘরের বাইরে মানুষের ছোটাছুটি। দোকানপাট বন্ধ করার ভয়ঙ্কর আওয়াজ। অসংখ্য দোকানের কোলাপসিবল গেটের শাটার টানার শব্ধ। সঙ্গে সঙ্গে চিকার , দৌড়াদৌড়ি। বাইরের দরজা খুলতেই সেই হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ করার মতো সংবাদ। ” The light is out” ভারত, বাংলাদেশের প্রিয় নেত্রী ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঘটনা।
অমৃতসরে শিখ বিদ্রোহী ভিন্দ্রেনওয়ালা স্বর্নমন্দির দখল করে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তাকে শায়েস্তা করতে স্বর্ন মন্দিরে সেনা অভিযান চালিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে রূপান্তরিত হয়েছিল স্বর্ণমন্দির। শিখ বিদ্রোহী ভিন্দ্রেনওয়ালার মৃত্যু হয়েছিল। আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কট্টরবাদীরা অভিযোগ তুলেছিল সেনা বাহিনী স্বর্ন মন্দিরে প্রবেশ করে মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মিটিং,মিছিল, চিৎকারের খবরে গোয়েন্দারা ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু না,তিনি এটাকে এতটা গুরুত্ব দেন নি। বারবার সতর্ক করা হলেও রাজি ছিলেন না দেহরক্ষী পরিবর্তন করতে,যাদের পরপর ১৬ টি গুলিতে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ৩১ অক্টোবর গুলিবিদ্ধ হন ইন্দিরা গান্ধী। সেদিন দিনের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ছিল পিটার উস্তিনভের সঙ্গে। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ওপরে একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন সেই সময়ে। আগের দিন ওড়িশা সফরের সময়েও তিনি শুটিং করেছিলেন। দুপুরে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালিঘান আর মিজোরামের এক নেতার সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলায় ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে একটা ডিনার দেওয়ার কথা ছিল সকালে যখন তিনি রাজীব গান্ধীর ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন,তখন দুই শিখ দেহরক্ষী অভিবাদন জানালে উত্তরে ইন্দিরা নমস্তে বলেন। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই দেহরক্ষীদের সম্মিলিত গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা। প্রথম গুলিটা পেটে লেগেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুটো গুলি তার বুকে আর কোমরে লাগে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটলেই ফিরতি গুলিতে এক নিরাপত্তারক্ষীর মৃত্যু হয়। তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শরীর,সোনিয়া গান্ধী তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেন। খুব জোরে গাড়িটা ‘এইমস’ বা অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্সের দিকে এগোতে থাকে। চার কিলোমিটার রাস্তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেরিয়ে যায়। সোনিয়া গান্ধীর ড্রেসিং গাউনটা ততক্ষণে ইন্দিরা গান্ধীর রক্তে পুরো ভিজে গেছে। ওই গাড়িটা ‘এইমস’এ ঢুকেছিল ন’টা ৩২ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীর রক্তের গ্রুপ ছিল ও নেগেটিভ। ওই গ্রুপের যথেষ্ট রক্ত মজুত ছিল হাসপাতালে কিন্তু সফদরজং রোডের বাসভবন থেকে কেউ ফোন করে হাসপাতালে খবরও দেয়নি যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুতর আহত অবস্থায় এইমস-এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জরুরী বিভাগের দরজা খুলে গাড়ি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে নামাতে মিনিট তিনেক সময় লেগেছিল কিন্তু সেখানে তখন কোনও স্ট্রেচার নেই। কোনওরকমে একটা স্ট্রেচার যোগাড় করা গিয়েছিল। গাড়ি থেকে তাকে নামানোর সময়ে ওই অবস্থা দেখে সেখানে হাজির ডাক্তাররা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান। ফোন করে সিনিয়র কার্ডিয়োলজিস্টদের খবর দেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার গুলেরিয়া, ডাক্তার এম এম কাপুর আর ডাক্তার এস বালারাম ওখানে পৌঁছে যান। ইসিজি করা হয়েছিল কিন্তু তার নাড়ীর স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল যে মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে। একজন চিকিৎসক মুখের ভেতর দিয়ে একটা নল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ফুসফুস পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে। মস্তিষ্কটা চালু রাখা সবথেকে প্রয়োজন ছিল তখন ডাক্তার গুলেরিয়া বলছেন, “আমি তো দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম যে উনি আর নেই। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি করতে হয়েছিল। তারপরে আমি ওখানে হাজির স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্করানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,এখন কী করণীয়? ঘোষণা করে দেব আমরা যে উনি মৃত? তিনি না বলেছিলেন। তখন আমরা মিসেস গান্ধীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাই। “চিকিৎসকরা ‘হার্ট এন্ড লাং মেশিন’ লাগিয়েছিলেন ইন্দিরার শরীরে। ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে কমে ৩১ ডিগ্রি হয়ে গেল। তিনি যে আর নেই,সেটা সকলেই বুঝতে পারছিল কিন্তু তবুও ‘এইমস’ এর আটতলার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। চিকিৎসকেরা দেখেছিলেন যে যকৃতের ডানদিকের অংশটা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বৃহদান্ত্রের বাইরের অংশটা ফুটো হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্রান্ত্রেরও। ফুসফুসের একদিকে গুলি লেগেছিল আর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল গুলির আঘাতে। তবে হৃৎপিণ্ডতে কোনও ক্ষতি হয়নি। দেহরক্ষীদের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হওয়ার প্রায় চার ঘণ্টা পর, দুপুর ২ টো ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল এরপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। জনতা উন্মাদের মতো আর্তনাদ করতে থাকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে শিখ সম্প্রদায়ের ওপর। সারা দিল্লি হয়ে ওঠে অগ্নি গর্ভ। বহু নিরীহ মানুষের প্রান যায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য ইন্দিরা অনুগামীদের হাতে। কয়েকদিন ধরে চলতে থাকে সেই ধ্বংস যজ্ঞ। পরবর্তী কালে আদালতের নির্দেশে বহু শীর্ষ মন্ত্রী,নেতার শাস্তি হলেও এই অধ্যায় ভারতের ইতিহাসে এক কালো অন্ধকার অধ্যায় বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য আমেরিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এই ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন কলকাতায় একটি জনসভায় ভাষণ অসমাপ্ত রেখে দিল্লিতে ফিরেই। আমি তখন খুবই ছোট। কৈশোর থেকে সবে যৌবনে পা রেখেছি এবং সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি দিচ্ছি।
ইন্দিরাকে বলা হতো, Indira is India । সেই ইন্দিরার মৃত্যুতে কয়েকটি দিন মনে হয়েছিল,মৃত্যু হয়েছে ভারতেরও।তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন দেখেছি হাজার হাজার শোকার্ত মানুষের আর্তনাদ, কান্না। কেউকেউ আছড়ে পড়েছেন মাটিতে। সত্যি সেদিন মনে হয়েছিল ” দি লাইট ইজ আউট”।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply