একটি দেশ বা জাতির আত্মপরিচয় তার লোকসংস্কৃতি। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিই বাঙালির মূল সংস্কৃতির ভিত্তি। এখানকার বাঙালিয়ানা সাহিত্য, জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনাচরণ লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই প্রবাহমান।
লোক সঙ্গীত বাঙালি সঙ্গীতের একটি অন্যতম ধারা। এটি মূলত বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সঙ্গীতে। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, আবেগ, অনুভূতি, সহানুভূতি, রাগ, অনুরাগ, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি থাকা সত্তে¡ও আমরা বাঙালি এটাই সবচেয়ে বড় অভিন্ন পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি সারা বিশে^র দরবারে। এই পরিচয়ে লোকসঙ্গীত আমাদের বাঙালি পরিচয়কে আরো এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
“সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ গোপাল হালদার হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গ সংস্কৃতিকে ‘পল্লী প্রধান বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন। গ্রাম থেকে যে সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, তাকেই এককথায় লোকসংস্কৃতি বলা যেতে পারে। সাহিত্য বিষয়ক গবেষক ওয়াকিল আহমদের মতে, ‘বাংলা সংস্কৃতিকে নগর সংস্কৃতি, লোক সংস্কৃতি এবং আদিম সংস্কৃতি- এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। তবে লোক সংস্কৃতিই হচ্ছে বঙ্গসংস্কৃতির প্রধান ধারা। লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, ‘লোক সমাজের জীবনাচরণ ও ভূয়োদর্শনের প্রতিফলন আছে লোক-বিশ্বাস, লোক-সংস্কার আর লোকাচারে।”
তবে পুঁথি পাঠ যে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এখনও গ্রামাঞ্চলে খুঁজলে দু-একজন পুঁথি পাঠক পাওয়া যেতে পারে। পাবনা জেলা আতাইকুলা থানার শোলাবাড়ীয়া গ্রামের “ঝড়– মিস্ত্রী” এখনও পুঁথি পাঠ করে বাঙালির মনোরঞ্জন করে থাকে। তবে এরাঁ নিজেদের জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। এঁরা বিদায় নিলে পুঁথি পাঠ করবার আর কোনো মানুষই হয়ত পাওয়া যাবে না।
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত প্রকার লোকসংগীতের প্রচলন আছে। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান, আলকাপ, লেটো, গাজন, বারমাসি, ধামালি, পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি গান এখন আর সেভাবে শোনা যায় না। ইসলামী লোক সংস্কৃতিতে কালুগাজীর গান, জীন্দাপীর মাদার মনির বাঁশ তোলা ও পালাগান বাঙালির হৃদয়কে নাড়া দেয়।
বাংলা লোকজ খেলাধুলাও তো কম নয়। ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, টোপাভাতি, নুনতা খেলা, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বাঘ ছাগল খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, বলী খেলা, লাটিম, ষোল গুটি, এক্কাদোক্কা, নৌকা বাইচ, ক্রিকেট, ফুটবল, লড়িলাঠি খেলা প্রভৃতি।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহি নৌকা বাইচ, আবহমান বাংলার মাটির গান, লোক সঙ্গীতকে এখনও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম রয়েছে দেশের মাজার কেন্দ্রিক একঝাক বাউল সাধক ও গ্রামবাংলার একশ্রেণির বাওয়াইয়া, বাউল, লালন শিল্পীগন।
লেখক: শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিহাব উদ্দিন শেখ এর ছেলে
শেখ নজরুল ইসলাম
সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক,
পরিচালক প্রশাসন,
দুরন্ত সত্যের সন্ধানে (দুসস)
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply