রাজধানীর মিরপুর-১০, পলাশনগর ও আশপাশের এলাকায় খোদ ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী মানিকের নেতৃত্বে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জমি দখলের শক্তিশালী সিন্ডিকেট থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার নামে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি, রাস্তা দখল, লেগুনা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, মাদক কারবারিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং ড্রেন পরিষ্কারের নামে চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলর হিসেবে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য জমি দখলসহ নানা অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মিরপুর-১০, পলাশনগর, ইমাননগর ও আশপাশ এলাকায় জাল দলিলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জমিজমা দখলের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কাউন্সিলর মানিক এ সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। তার মূল সহযোগী হিসেবে রয়েছেন সাবেক বিএনপি নেতা ফরহাদ আলম ভূঁইয়া স্বাধীন, শহীদুল ইসলাম জীবন ও হারুন অর রশিদ এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া ও বিপ্লব।
পল্লবী থানার ৫ নম্বর পলাশনগরের স্থায়ী বাসিন্দা অহিদ মোল্লার মেয়ে নুরুন নাহার বলেন, এলাকায় মানিকের ক্যাডার হিসেবে পরিচিতি ভূমিদস্যু বিএনপি নেতা ফরহাদ আলম ভূঁইয়া স্বাধীন ও হারুন অর রশিদ জোর করে আমাদের জমি দখল করে নিয়েছেন। মানিকের নির্দেশে মানিকের হয়ে তারা এ দখলবাজি করছেন। স্বাধীন ও হারুন যে দলিলের কথা বলছেন সে দলিলে শনাক্তকারী ও পরিচয়দানকারী এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক। নূরুন নাহারের আরও অভিযোগ, ২০১০ সালে তার বাবা-মা জীবিত থাকার সময় তাদের দুই বোনকে ২৮ শতাংশ জমি কিনে দেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পর জাল দলিল করে কাউন্সিলর মানিক তার অন্য সহযোগী শহিদুল ইসলাম জীবনের মাধ্যমে ওই জমি দখল করে নেন। মানিকের এসব দখল ও সম্পত্তি আত্মসাতের বিরুদ্ধে নথিপত্রসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। সাংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানায়, মানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নিজের ও শ্বশুরের নামে পলাশনগরে কমপক্ষে সাতটি বাড়ি দখল করেছেন। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা সাংবাদিকদের জানান, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকে ৩৪ নম্বরের সড়কের ৪ নম্বর বাড়ি, ২৮ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর বাড়ি, ২২ নম্বর বাড়ি ও ২৪ নম্বর বাড়ি, ২৯ নম্বর সড়কের ১৭ নম্বর বাড়ি, ৩৩ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর বাড়ি ও ২৭ নম্বর সড়েকের ১৮ নম্বর বাড়ি জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করেছেন কাউন্সিলর মানিক। ওই নেতা আরও জানান, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকের রাড্ডা-বার্নান মূল সড়কের সংযোগ সড়ক থেকে অ্যাভিনিউ-১-এর ঝুটপট্টি রোডের উত্তর মাথায় শহীদ আবু তালেব উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের রাস্তা দখল করে ভবন করেছেন কাউন্সিলর মানিক। নকশা বর্ধিত করে ৪০ ফুট রাস্তার ৬ ফুট চওড়া ও ৭০ ফুট লম্বা জমি দখল করেছেন। তার এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য এলাকার তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ঢাকা উত্তরের মেয়রের কাছে একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, র্যাবের প্রধান, পুলিশ কমিশনার, মিরপুর বিভাগের পুলিশ কমিশনারের কাছেও অভিযোগ দিয়েছেন।
পলাশনগরের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, মানিকের অন্যতম সহযোগী ফরহাদ আলম ভূঁইয়া স্বাধীন একসময় চটপটি বিক্রেতা ছিলেন। মানিকের সঙ্গে দখল বাণিজ্যের মাধ্যমে এখন তিন-চারটি বাড়ি ও একটি কারখানার মালিক। মাটির মায়া রিয়েল স্টেট নামে স্বাধীনের প্রতিষ্ঠানও আছে। কাউন্সিলর মানিকের অবৈধ দখলবাজি সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য দেলোয়ার গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। এখন মানিকের সহযোগী, মিরপুরে ছয়-সাতটি বাড়ি আছে তার। আরেক সদস্য শাহীন মিরপুরে ওয়াসার একটি পানির পাম্পে চাকরি করতেন। তাকে ‘পানি শাহীন’ নামে চেনে স্থানীয়রা। বর্তমানে তিনি তিন-চারটি বাড়ির মালিক।
অভিযোগ আছে, কাউন্সিলর মানিকের আরেক সহযোগী কাজী হারুন কাফরুলের আওয়ামী লীগ নেতা আরিফুর ইসলাম বাবুর ২০ কাঠা জমি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে তারা নানা কৌশলে ১০ কাঠা দখলও করেছেন বলে অভিযোগ বাবুর। তিনি বলেন, পলাশনগর, ইমাননগর, অ্যাভিনিউ-৫ এলাকায় কাউন্সিলর মানিক কত জমি-বাড়ি দখল করেছেন তার হিসাব পাওয়া মুশকিল। মানিক বাহিনীর অত্যাচারে বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। থানা পুলিশের কাছেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাউন্সিলর মানিকের আয়ের বড় একটি খাত মিরপুর ১০ নম্বরের হোপ স্কুলের গলি। সেখানে বসানো হয়েছে বাজার। পাঁচ বছর ধরে সেখানে প্রায় এক হাজার দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন মানিক। দোকান বরাদ্দ দেওয়ার নামেও এককালীন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগে সিটি করপোরেশন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। পরে আবার মানিক সেখানে প্রায় ৫০০ দোকান বসিয়েছেন। সেখানকার দোকানিরাও নিয়মিত মানিককে চাঁদা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
স্থানীয়রা বলছে, মিরপুর-১০ নম্বরে লেগুনা স্ট্যান্ড ও অ্যাভিনিউ-৫-এর লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদা ওঠে মানিকের নামে। অন্যান্য ফুটপাত ও ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকেও মানিকের ক্যাডারদের চাঁদা দিতে হয়। স্থানীয় এক যুবলীগ কর্মী সাংবাদিকদের বলেন, মিরপুরের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এই মানিকের হাতে। নিজে তাবলিগ জামাতের অনুসারী হলেও তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে মাদক কারবারিরা। তিন নম্বর ওয়ার্ডে ছোট-বড় ১৩টি বিহারি ক্যাম্প ও ৯টি বস্তি কেন্দ্রীয় মানিকের ক্যাডার বাহিনী ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করে। কাউন্সিলরকে টাকা দিয়ে বিহারি ক্যাম্পগুলোতে বাবর ওরফে হিজড়া বাবর, কাল্লু ওরফে বাবা (ইয়াবা) কাল্লু, আজহার ও আরমানের নেতৃত্বে বিশাল সিন্ডিকেটে মাদক কারবার দেখাশোনা করে। হিজড়া বাবর নিজেকে হিজড়া দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সে হিজড়া নয়। তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি কাল্লু সেকশন-১১, মুসলিম ক্যাম্পসহ আশপাশ এলাকায় মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সাংবাদিকদের বলেন, মুসলিম ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি পরিত্যক্ত মার্কেট আছে। সেখানে কাউন্সিলর মানিকের নামে তার লোকজন পাঁচ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা রাখে। ওইসব রিকশা চার্জ দেওয়া হয় সেখানে। পরিত্যক্ত মার্কেটে গ্যারেজ ও ব্যাটারি চার্জের যে টাকা আসে তা যায় মানিকের পকেটে। মানিকের হয়ে এসব টাকা আদায় করে আজহার ও আরমান। তারা আরও জানান, পরিত্যক্ত এই মার্কেটটি মাদক কারবারি ও মাদকসেবীদের আখড়া। ২০০৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সেখানে মাদক কারবার নিয়ে বিরোধের জেরে পাঁচটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। স্থানীয় বিহারিদের পক্ষ থেকে মার্কেটটি ভেঙে ফেলা বা সেটা বাউন্ডারি দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু কাউন্সিলর মানিক সায় দেননি। অভিযোগ রয়েছে, মানিক একসময় মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহদাতের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে কাজ করতেন। টাকা নিয়ে বিরোধের কারণে শাহদাত গুলি করেন মানিককে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মানিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ২০১০ সালে পলাশনগর বিলের মধ্যে কিছু জমি ক্রয় করি। সার্ভেয়ারের মাধ্যমে তিন দিন ধরে মাপজোক করে আমার জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তখন সেখানে ২০-২২ ফুট পানি ছিল। আমি মাটি ভরাট করে সেটা নিয়ম অনুযায়ী কিছু আমার দখলে ও কিছু বিক্রি করেছি। অভিযোগকারী নুরুন নাহার পলাশনগরে আমার বাসার ১০০ গজের মধ্যেই থাকে। তিনি তার মায়ের কাছ থেকে ২০১২ সালের একটি হেবা (দানপত্র) দলিলে ওই জমি তাদের বলে দাবি করছেন। এর কোনো ভিত্তি নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা (নুরুন নাহার) এতদিন আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ, জিডি বা মামলা করলেন না। আমি কাউন্সিলর হওয়ার পর আমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় এমপিকে বিষয়টি জানিয়েছি। আমি তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করব। আমি কোনো ধরনের অবৈধ দখলের সঙ্গে জড়িত নই।’ হোপ স্কুল গলিসহ বিভিন্ন ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে মানিক বলেন, ‘হোপ স্কুলের পাশে ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ২০০ হকারকে বসার অনুমতি দেন। সম্প্রতি রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শেষ হওয়ার পর আগের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও আমি তাদের বসতে দিইনি। এরপরও কেউ ভ্যানগাড়িতে বা অন্য কোনো উপায়ে বসছে। পুলিশের সহযোগিতায় তাদের তুলে দেওয়া হয়।’ মাদক প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমি মাদককে ঘৃণা করি। এলাকায় মাদক উৎখাতের জন্য পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি।’
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply