দুসস ডেস্কঃ বিশ্বের বহু দেশে স্বাধীনতা দিবস এবং সংবিধান প্রবর্তন দিবস রয়েছে, এ ছাড়াও ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ নামে একটি জাতীয় দিবস পালিত হয়। যেমন, ইতালি (২ জুন ১৯৪৬), ইরাক (১৪ জুলাই ১৯৫৮), ইরান (১ এপ্রিল ১৯৭৯) ও নেপাল (২৮ মে ২০০৮)।
ইরাকের জন্য দিনটি রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে ‘প্রজাতন্ত্রে’ রূপলাভের দিন, ইরানের কাছে দিনটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হওয়ার দিন; আর নেপালের জন্য এটি ধর্মভিত্তিক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের দিন। ভারত পাকিস্তান অবশ্য নিজ নিজ দেশের সংবিধান প্রবর্তনের দিনকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিকভাবে বর্বর আক্রমণের শিকার হয়ে পূর্ব বাংলা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা দিবস’। প্রায় ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ভোগ করছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যার প্রেক্ষিতে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ‘বিজয় দিবস’। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়; তাই ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান দিবস।
কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্র দিবস নেই। অথচ দিবসটি ঐতিহাসিক ভাবে বিদ্যমান। দিবসটি ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শপথ গ্রহণের দিন। এ’দিনটি বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়কি।
যদিও দিবসটি পালিত হয়; কিন্তু অন্য নামে। দিবসটিকে আমাদের দেশে মুজিবনগর সরকার দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
ইতিহাসের কয়েকটি পাতা উল্টে দেখা যাক। দীর্ঘ ২৩ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ৬ দফার প্রতি একাত্ম হয়ে ১৯৬৯ সালে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি।
বরং সংসদ অধিবেশন ডেকেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন, তা জাতিকে দৃঢ়ভাবে একতাবদ্ধ করে তোলে।
তাই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে এ জাতি যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা শুরু করে ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ী এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বিচক্ষণ ও নিবেদিতপ্রাণ তাজউদ্দীন আহমদ এবং সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অন্য নেতারা আক্রান্ত দেশ থেকে পাশের দেশ ভারতে গিয়ে একত্র হয়ে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করেন এবং স্বাধীন দেশ বাস্তবে অর্জনের জন্য অল্পসংখ্যক মন্ত্রী নিয়ে একটি সরকার গঠন করেন।
স্বাধীনতার ওই ঘোষণাপত্র ইংরেজিতে রচনা করা হয়েছিল, যাতে তা বিশ্বের কাছে সহজে বোধগম্য হয়। ওই ঘোষণার প্রধান অংশের বাংলা অনুবাদ এ রকম:
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন, সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নবনির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের জন্য গঠিত সরকার বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দান করে। ওই সরকার কলকাতার থিয়েটার রোডে অফিস নিয়ে ‘প্রবাসে’ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনা করে।
বস্তুত স্বাধীনতার ওই ঘোষণাপত্র তৈরি করা এবং সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণ ছিল এক যুগান্তকারী অবিস্মরণীয় ঘটনা। এমন যুগান্তকারী ঘটনার দিনকে শুধু ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে পালন করলে এর তাৎপর্য খাটো করা হয় এবং জাতির প্রধান নেতাদের অবদানেরও যথার্থ মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এভাবে আমরা গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী চিন্তায় দেশ ও জাতির সংহতি গড়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলি। (সংকলন)
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply