ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়: একটা সময় ছিলো যখন ব্রিটিশ আমলে লর্ড গোখলে বলেছিলেন ” What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”.। কিন্তু আজ বাঙালি সেই মর্যাদা ,ভাবমূর্তি ,ঐতিহ্য সম্পূর্ন বিসর্জন দিতে বসেছে। আজ আমরা সবাই অনেকেরই পিছনে গিয়ে মুখ লুকিয়েছি। এটা লজ্জার। একমাত্র বাংলাদেশেই বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ। বাঙালি বলতে গর্ব বোধ করেন তারা। এই ঐক্যবদ্ধতার ফলে তারা অত্যাচারী পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পেরেছে।
আমরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো নিয়ে স্কুলে পড়েছি।ইতিহাসখ্যাত এই দুটি স্মৃতি সৌধ আজও পর্যটকদের টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করেছিলেন যে বিশ্ববিখ্যাত পুরাতত্ত্ব বিশারদ,সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা একবারের জন্যও মনে রাখিনি। সোশ্যাল মিডিয়া দৈনিক কতো মনীষীদের নিয়ে তথ্য সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় গত ১২ এপ্রিল তার জন্ম বার্ষিকীতে একটিও লেখা দেখা গেল না। কোন স্মৃতিচারণ দেখা যায় নি। ২৩ মে তার মৃত্যু বার্ষিকী। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরেই। কিন্তু কোন চর্চা দেখা যাচ্ছেনা।মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের কৃতি সন্তান রাখলদাসের জন্ম, এবং এই মে মাসেই তার মৃত্যু।
ঔপন্যাসিক তথা সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান রাখালদাস ইতিহাসে ঐতিহাসিক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। মানুষের ঐতিহাসিক প্রগতির মূক নিদর্শন ও জড়েরমুখ দিয়ে ইতিহাসের ঘটনাবলীকে ঔপন্যাসের মাধ্যমে প্রকাশ করে রাখালদাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিচিত্র দিগদর্শনকে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন। ইতিহাস আলােচনার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তিনি যে কতগুলি উপন্যাস রচনা করেছেন তা একাধারে উপন্যাস ও নৈর্ব্যত্তিক ঐতিহাসিক চিত্র। বস্তুতঃ তাঁর হাতেই ঐতিহাসিক উপন্যাস ভারতবর্ষে বিশেষতঃ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মর্যাদা লাভ করেছে।
১৮৮৫ সালের ১২ ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে রাখালদাসের জন্ম। তার পিতা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরে ওকালতি করতেন।
শিক্ষা জীবন:
বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে তিনি ১৯০০ সালে পাশ করেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হবার আগেই তখনকার সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেন। বিয়ের পর এই কলেজ থেকে ১৯০৩ সালে এফ.এ পাশ করেন। এই সময়ে পিতামাতার মৃত্যু এবং নানা বৈষয়িক ঝামেলার জন্য পড়াশােনা বন্ধ থাকে। এরপর ১৯০৭ সালে ইতিহাসে অনার্স সহ বি.এ. এবং ১৯১০ এ এম.এ পাশ করেন।
বি.এ পরীক্ষা পাশ করার আগেই রাখালদাস প্রাচীন লেখ ও মুদ্রা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে খাতি লাভ করেন। ১৯০৬ সালে বঙ্গীয় এশিয়াটিক সােসাইটি পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যা প্রাচীন পণ্ডিত ভিনসেন্ট ও স্মিথ কর্তৃক প্রশংসিত হয়।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর কর্ম জীবন:
১৯১০ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে সহকারী থেকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হন, পরে অধ্যক্ষের পদ লাভ করেন। কৈশাের থেকেই রাখালদাস ভারতীয় ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। এফ. এ পড়ার সময়েই তিনি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ব্লক সাহেবের সাহচর্যে আসেন এবং প্রাচীন লিপি পাঠে দক্ষতা লাভ করে। এই শিক্ষা তার কর্মজীবনে সবিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
১৯২২ সালের গােড়ার দিকে রাখালদাস কর্মসূত্রে সিন্ধু দেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারাে পরিদর্শনে যান এবং এখানে খনন কার্যের মাধ্যমে মহেঞ্জোদারাের সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার রাখালদাসের জীবনের অবিনশ্বর কীর্তি।
তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার ধারক। পুরাতন লেখাদির পাঠ ও ব্যাখ্যা, সুপ্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মুদ্রার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্ণয়, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শনের মূল্য বিচার, লেখ ও মুদ্রাদির সাহায্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন যুগের প্রামাণিক ইতিহাস রচনা প্রভৃতি ছাড়াও তার কীর্তির স্বাক্ষর রয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পটভূমিকায় লিখিত মনােরম উপন্যাসে।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর রচনা:
১৯২৬ সালে বিভাগীয় কাজে মতভেদের কারণে চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯২৮ থেকে রাখালদাস বারানসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপকের চাকুরি গ্রহণ করেন। কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার মধ্যেও গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদি রচনায় তার বিরাম ছিল না। তার প্রবন্ধাদি বঙ্গীয় এশিয়াটিক সােসাইটি পত্রিকা, বিহার রিসার্চ সােসাইটি পত্রিকা, Epigraphia Indica, লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সােসাইটি পত্রিকা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, Indian Antiquary, Annals of Bhandarkar Oriental Research Institute, ভারতবর্ষ, প্রবাসী ইত্যাদি ইংরাজি ও বাংলা সাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তাঁর রচনাবলীর মাধ্যমে যে বহু মূল্যবান তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন তার মূল্য অপরিসীম। মুদ্রাতত্ত্বে সুপণ্ডিত রাখালদাস মুদ্রা বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রাচীন মুদ্রাগ্রন্থটি প্রকাশের আগে বাংলা বা ইংরাজি ভাষায় এই বিষয়ের ওপর অপর কোন গ্রন্থ ছিল না। রাখালদাস রচিত অন্যান্য গ্রন্থ দুই খণ্ডে বাংলার ইতিহাস, পাষাণের কথা, ত্রিপুরীর হৈহয় জাতির ইতিহাস ; উড়িষ্যার ইতিহাস, বাঙ্গালীর ভাস্কর্য, শশাঙ্ক, ধর্মপাল, করুণা, ব্যতিক্রম, অসীম, পক্ষান্তর, অনুক্রম, The Origin of Bangali Script, Palas of Bengal প্রভৃতি।১৯৩০ সালের ২৩ মে রাখালদাসের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।আমরা বাঙালিরা স্টালিন, লেনিন, শেক্সপিয়ারের কথা অনর্গল বলে থাকি, কিন্তু আমাদেরই বাংলার গর্ব রাখলদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বেতার ও গাছের প্রাণ রয়েছে আবিষ্কারের কর্তা জগদীশ চন্দ্র বসু,ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, কালা জ্বরের ওষুধের আবিষ্কারের বিজ্ঞানী ইউ এন ব্রহ্মচারী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ,বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা ও অনেক কৃতি বাঙালির কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। আমরা বাঙালিরা নিজেদের ভাষা,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে বসেছি। আজকাল আমরা একবারও বলিনা “বর্ন পরিচয়” এর রচয়িতা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, “মেঘনাদ বধ” কাব্যের রচয়িতা, অমৃতাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সমাজের বঞ্চিতদের সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ডি এল রায়, অতুলপ্রসাদের কথাও। সতীদাহ প্রথা রদ করার নায়ক রামমোহন রায়ের কথাও ভুলে যাই আমরা। ঠিক একই ভাবে উপেক্ষিত রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মে মাসের ৩০ তারিখেই ১৯৩০ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোক গমন করেন।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply