তিন কোটি একুশ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ; কিন্তু সেই কাজের জন্য ঘুষই দিতে হয়েছে প্রায় ৬১ লাখ টাকা। দরপত্র থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে এই টাকা নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ডের রাস্তা উন্নয়ন কাজে অস্বাভাবিক ঘুষ লেনদেনের এ ঘটনা ঘটে। সংস্থাটির উপসহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদিন নিজ হাতে নগদ নিয়েছেন ৪২ লাখ টাকা। তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়া হয় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। বিভিন্ন সময় ‘টেবিল খরচ’ এর নামে অন্যদের দিতে হয়েছে বাকি টাকা। গণমাধ্যমের কাছে আসা ভিডিও রেকর্ড ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
জানাযায়, ২০২০ সালের দিকে টেন্ডার আহ্বান করা হয় উক্ত কাজের। ওই ওয়ার্ডের ময়দার মিল রোড, ইসমাইল ফয়েজ এবং আব্দুল করিম রোডে এসব উন্নয়ন কাজ করে নাওয়াল কনস্ট্রাকশন এবং মা-বাবা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। শুরুতে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার টেন্ডার থাকলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে এই টেন্ডারের মূল্যমান ধরা হয় ৩ কোটি ২১ লাখ ২৭ হাজার ৯১৯ টাকা।
গণমাধ্যমের কাছে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি টেবিলে বসে আছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদিন। এ সময় তার পাশেই উপস্থিত দেখা যায় আরেক সহকারী প্রকৌশলী রিফাত হোসেনকে। সেখানে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি একটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে তাদের হাতে তুলে দেন। উপসহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদিন টাকাগুলো নিজে গুনে হিসাব করে নেন। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ওই সময় একসঙ্গে প্রায় ৪২ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয় প্রকৌশলীদের। এ ছাড়া সাউথইস্ট ব্যাংকের এমকে ব্রাঞ্চের শাখায় নুসরাত সাবরীনা নামে এক নারীর অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নুসরাত সাবরীনা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উপসহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী।
জানা যায়, ঠিকাদারি কাজের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিলের ওপর ১৫ শতাংশ টাকা ভ্যাট এবং কর হিসেবে সরকারি খাতে কেটে রাখা হয়। ঘুষ হিসেবে প্রকৌশলসহ বিভিন্ন দপ্তরে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ টাকা। ফলে উন্নয়ন কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। কাজের মানও খারাপ হয়।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আয়নুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কাজটি নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। প্রকৌশলীরা নিজ হাতে এই টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এরপর কাজ চলাকালে এবং বিল দেওয়ার সময়ে ব্ল্যাকমেইল করে আরও টাকা নেওয়া হয়। আমরা ওই সময় অসহায়। পদে পদে হয়রানি করে টাকা নিলেও চূড়ান্ত বিল দিতে গড়িমসি করে।’
অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘুষ নেওয়ার এমন কোনো ঘটনা আমার মনে পড়ছে না। আমি এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই।’
পরে তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া চেক এবং সরাসরি টাকা নেওয়ার ভিডিওর বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এরপর বলেন, ‘করপোরেশনে আমি একজন ছোট প্রকৌশলী। আমার একার পক্ষে একটি কাজ বাবদ এত টাকা নেওয়া সম্ভব নয়।’
তাহলে কাদের কাদের ভাগ দিতে হয় এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি আর কথা বলতে চাননি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শাহীন-উল ইসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে অবশ্যই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঠিকাদাররা কাজ করবেন, প্রকৌশলীদের কাজ হচ্ছে দেখভাল করা। সঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কি না, তা দেখা। সেখানে এভাবে ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘুষ লেনদেন অপরাধ। এখানে যেহেতু সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ আছে, তাই এ বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাজ করতে পারে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার দুটি দিক খতিয়ে দেখতে হবে। একটি হলো, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে যেহেতু এ ঘটনাটি ঘটেছে, সেখানে এমন ঘটনা নিয়মিত কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কারা কারা জড়িত সেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট আছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখে দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনো ঠিকাদার নিজের পকেট থেকে ঘুষ দিয়ে কাজ করবেন না। ফলে জনগণের অর্থে হওয়া কাজের গুণগত মান খারাপ হবে। জনগণের অর্থের অপচয় হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply