নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ওসি মাহমুদুল হাসানের মাসিক আয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। আসামি ধরা-ছাড়া নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। তার কাছে জিম্মি হয়ে নিরীহ মানুষকেও বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে ছাড়া পেতে হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ওসি মাহমুদুল হাসানের মাসিক আয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। আসামি ধরা-ছাড়া নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। তার কাছে জিম্মি হয়ে নিরীহ মানুষকেও বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে ছাড়া পেতে হচ্ছে।
এছাড়া দাবি পূরণ না হলেই নিরীহ মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করারও অভিযোগ রয়েছে। এসব বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করায় উপজেলায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যাসহ অপরাধ কর্মকান্ড বেড়ে গেছে। ওসির এমন অবৈধ কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। এভাবে চলতে থাকলে রূপগঞ্জ অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
এসপি হারুন অর রশিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে ওসি মাহমুদুল হাসান এখনও বেপরোয়া। ওসির সেল্টারে চোরাই তেল থেকে শুরু করে জুয়া ও মাদক স্পট চলছে। ওসির দম্ভোক্তি ‘আমি যখন যেখানে যেতে চাই সেখানেই বদলি হয়, না চাইলে কেউ বদলি করতে পারবে না’।
থানা সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে হারুন অর রশিদ যোগদানের পর মাহমুদুল হাসান রূপগঞ্জ থানায় গত বছরের ২৬ ফেব্রæয়ারি ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে যোগদান করেন। তখন এ থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আব্দুল হক। নানা কলাকৌশল করে যোগদানের এক মাসের মধ্যেই আব্দুল হককে সরিয়ে ওসির চেয়ার বাগিয়ে নেন মাহমুদুল হাসান। এরপর থেকেই এসপি হারুন অর রশিদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে দাপট দেখিয়ে মাসোহারা ও ধরা-ছাড়ার বাণিজ্য শুরু করেন।
অপরাধীদের সঙ্গে ওসির সখ্যতা থাকায় অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। তার এসব কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ থানায় কর্মরত অনেক কনস্টেবল থেকে শুরু করে এসআই ও এএসআইরাও। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। বর্তমান পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম যোগদানের পর কয়েক দিন বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও ওসির নির্দেশে আবারো তা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ওসি মাহমুদুল হাসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইফুল ইসলামকে (পুলিশ পরিদর্শক) ভোলাব তদন্ত কেন্দ্রে ইনচার্জ হিসেবে যোগদান করানো হয়। যোগদানের পর থেকেই সাইফুল ইসলাম মাটি চোর, মাদক ব্যবসায়ীসহ অপরাধীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ওসির সেল্টারে সেখানেও চলছে নানা ধরনের বাণিজ্য।
নাম না প্রকাশ শর্তে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানায়, ওসি নিজে তদারকি করে রাতের ডিউটি বন্টন করে দেন। বন্টনের পূর্বেই অফিসারদের বলে দেয়া হয় যে কোন মূল্যে লোকজন ধরতে হবে এবং ধরার পর উৎকোচ নিয়ে ছেড়ে দিতে হবে। রাতের টার্গেট দিয়ে দেয়া হয় অফিসারদের। যার ফলে দায়িত্বে থাকা অফিসাররা টার্গেট ফিলাপ করতে বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। এ কারণে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ওসির নির্দেশক্রমে প্রতিদিন রাতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আধুরিয়া, বাংলাকেট, তারাব, ভুলতা, এশিয়ান হাইওয়ে (বাইপাস) সড়কের কালাদি, পলখান, গোলাকান্দাইল, ৩০০ ফুট সড়কের ভোলানাথপুরসহ বেশ কয়েক স্থানে চেক পোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ।
সূত্র জানায়, ওসি মাহমুদুল হাসান এমন করে গাড়ি-বাড়ি, মার্কেট, জমি-জমাসহ অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তিনি নামে-বেনামে এসব সম্পত্তি রেখেছেন। রূপগঞ্জ গ্রামের গৃহবধূ খাদিজা বেগম অভিযোগ করেন, তার স্বামী ফারুক মিয়াকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলায় গ্রেফতার করে আরো মামলায় না ফাঁসানোর জন্য ৫ লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। দাবি পূরণ না করায় ফারুককে অন্য আরেকটি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়।
জানা গেছে, ওসির সেল্টারে উপজেলার চনপাড়া বস্তিতে ৩টি স্পটে নিয়মিত চলে জুয়ার আসর। স্থানীয়রা একে মিনি ক্যাসিনো স্পট হিসেবে চেনে। এসব আসর সরাসরি ওসিকে ম্যানেজ করেই চলছে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীরের পুত্র বাবু তার নিজ বাড়ির নদীর পাড়ে একটি ছাপড়া ঘরে, একইভাবে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আলফু মিয়ার বাড়ি স্থানীয় সন্ত্রাসী জয়নাল মিয়া ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে আনোয়ার তার নিজ বাড়িতে লাখ টাকার জুয়ার আসর পরিচালনা করছে। এসব স্পটে মাদকের ব্যবসাও চলে। এ আসর থেকে ওসিকে দৈনিক হারে দিতে হয় ১ লাখ টাকা। এভাবে এ ৩টি স্পট থেকেই মাসে ৩০ লাখ টাকা পান ওসি। এছাড়াও উপজেলার ভক্তবাড়িতে দুলালের বাড়ি, ইছাপুরার নবী হোসেনের দোকানে বসানো হয় নিয়মিত জুয়ার আসর।
শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর পাড় ও পূর্বাচলসহ বিভিন্ন এলাকায় রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা। এসব রিসোর্টে দেহ ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক ও জুয়ার আসর বসে। এসব খাত থেকেও লাখ লাখ টাকা মাসোহারা পান ওসি। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকেও পাচ্ছেন মাসোহারা।
ঢাকা বাইপাস মহাসড়কের গোলাকান্দাইল মোড় থেকে কালীগঞ্জের উলুখোলা পর্যন্ত রয়েছে ২৪টি খুপড়ি ঘর। এসব ঘরে হয় চোরাই তেলের কারবার। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ওসি মাহমুদুলকে ম্যানেজ করেই চলছে এ চোরাই কারবার। আর নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে ওসির বডিগার্ড রবিউল এবং ভাসমান দালাল ও ওসির ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিতি পিরোজপুরের শাহীন।
এর আগে, রূপগঞ্জে তেলচুরির এক মামলায় জড়িত না থাকার পরও একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করার অভিযোগ উঠে ওসির বিরুদ্ধে। গত বৃহস্পতিবার একটি তেল চোরাই মামলায় ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারভুক্ত ৮ আসামির মধ্যে টাইগার মোমেন ওরফে টাইগার মমিন (৩৫) ৩ মাস ধরে কারাগারে থাকলেও অন্য চোরদের বাঁচাতে তাকে পুনরায় আসামি করা হয়। এসব বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশের। কিন্তু লোক দেখানো ভূতুরে মামলা দিয়ে তেল চোর সিন্ডিকেট রক্ষায় আসামিদেরওসির সেল্টারে নাম ঠিকানা অজ্ঞাত লিখে মামলা করেন ওসি। অথচ গত ৪ ফেব্রুয়ারি একটি মামলায় ১ নম্বর আসামি মনির হোসেন কাল্লুকে গ্রেফতার দেখালেও অপর দুই আসামি আনোয়ার হোসেন এবং আব্দুল গণির নাম দিলেও পিতা ও ঠিকানা অজ্ঞাত দেখায়। সূত্র জানায়, আনোয়ার ও আব্দুল গণির নেতৃত্বে উপজেলার মহাসড়কে তেল চোরাইদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হত। এসব চাঁদা আনোয়ার সরাসরি ওসির হাতে তুলে দেয় বলে জানান পূর্বাচলের চোরাই তেল ব্যবসায়ীরা।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামসহ পূর্বাচলের আশপাশে গত ১ বছরে চুরি হয়েছে শতাধিক গরু। প্রতি রাতে স্থানীয় কৃষক ও খামারিরা পাহাড়া বসিয়েও চুরি রোধ করতে পারছেন না। এসব ওসিকে লিখিত জানালেও প্রতিকার পাননি তারা। গত ২৩ ডিসেম্বর রাতে উপজেলার গুতিয়াবো এলাকার বাসিন্দা আমানুল্লাহর ৮টি গরু, ১৮ জানুয়ারি মধূখালীর চান মিয়ার ৫টি গরু, একই এলাকার বেলায়াতের ৩টি গাভী, ৩ ফেব্রুয়ারি আলম হোসেনের ৪টি গরু নিয়ে যায় চোর।
ওসি যোগদানের পর থেকে বেড়েছে ডাকাতি। ১৮ জানুয়ারি রাতে তারাবো ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত আয়াত আলীর বাড়ি থেকে ডাকাতদলের সদস্যরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ৩ লাখ টাকা ও ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে দক্ষিণ রূপসীর দেলোয়ার নামে ব্যক্তির বাড়ি থেকে ডাকাত দলের সদস্যরা স্বর্ণালঙ্কারসহ ১ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নেয়। গত ২১ অক্টোবর কাঞ্চন পৌরসভার কেন্দুয়ারটেক এলাকায় ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতি হয়।
গত ৫ জানুয়ারি রাতে ইছাপুরা বাজারে ৪টি জুয়েলারী দোকানে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় স্থানীয় বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক রোমান মোল্লা থানার নাম্বারে ফোন দিয়ে সাড়া না পেয়ে ৯৯৯-এ কল দেন। ততোক্ষণে ৪টি দোকানের ৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ অর্থ লুটে নেয়। ভোটারদের মাঝে স্মার্ট কার্ড বিতরণের সময় পুলিশের উপস্থিতিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি গুতিয়াবো এলাকায় ৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
এ বছরের ১১ জানুয়ারি পূর্বাচল পরশি এলাকার সবজি বাগান থেকে নিখোঁজের দুই দিন পর ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক মজরউদ্দিনের (৪৫) হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১১ জানুয়ারি নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে তারাবো পৌর ছাত্রলীগ সহ-সভাপতিসহ ৬ জন। ২৯ জানুয়ারি কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ছাতিয়ান এলাকায় নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ধরনের অভিযোগ বা ঘটনার শেষ নেই। আইনশৃঙ্খলা অবনতির জন্য থানা পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply