করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘমেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গ্রামের মানুষের ৬২ শতাংশ এবং শহরের মানুষের আয়-রোজগার ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। কাজ হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ। আগে থেকেই দরিদ্র ছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। সবমিলিয়ে ৭ কোটি দরিদ্র মানুষ করোনার কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাদের খাদ্যসহায়তা এবং অতিপ্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে প্রতিমাসে ১০ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বুধবার ওয়েব সেমিনারে ঐ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।
ভার্চুয়াল সেমিনারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান, পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (জেষ্ঠ্য সচিব) অধ্যাপক শামসুল আলম, বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এতে ‘কোভিড-১৯ এর সময় জীবিকা, ক্ষতি ও সহায়তা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি হিসাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। করোনার কারণে দরিদ্র সংখ্যা আরো ২২ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে হবে ৪৩ শতাংশ।
অতিদরিদ্র, দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্রসীমার বাইরে জনগোষ্ঠী এবং দরিদ্রসীমার বাইরের জনগোষ্ঠী এই চার শ্রেণির ৫ হাজার ৪৭১ জন মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। যার মধ্যে ৫১ শতাংশ মানুষ গ্রামের। এতে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে এপ্রিলের তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এতে তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, পেশা ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি রোজগার কমেছে রেস্তোরাঁ কর্মীদের। তাদের রোজগার কমেছে ৯৯ শতাংশ। রোজগার কমার ক্ষেত্রে এর পরের অবস্থানে আছে ভাঙারি শ্রমিকদের। তাদের রোজগার কমেছে ৮৮ শতাংশ। রিকশা চালকদের আয় কমেছে ৮৪ শতাংশ। দিনমজুর ও শিল্পী সমাজের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। মালি ও কারখানা কর্মীদের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। এছাড়া দক্ষ শ্রমকিদের ৭৯ শতাংশ, কৃষি শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৭৩ শতাংশ, দোকান/ সেলুন/ পার্লারের রোজগার কমেছে ৭২ শতাংশ। পোশাক কর্মীদের আয় কমেছে ৪৯ শতাংশ, কৃষকের ৪৪ শতাংশ, পিয়ন ও নিরাপত্তারক্ষীদের ৪৩ শতাংশ, অফিসের আনুষ্ঠানিক কর্মীদের কমেছে ৩৩ শতাংশ এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আয় কমেছে ২৭ শতাংশ। আয় কমে যাওয়ায় তাদের খাবার ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, করোনার কারণে মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদেরকে অবশই সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি কতদিন থাকবে সেটি বলা যাচ্ছে না। তবে পূর্বাভাস হলো এটি আরো বাড়বে। বতর্মান পরিস্থিতিতে সরকারি ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে নগদ সহয়তা দেওয়া হচ্ছে। এটা বাজার ব্যবস্থায় বড়ো ধরনের প্রভাব পড়বে। তবে এক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রবাহ বেড়ে গেলে বাজারে চাহিদার ওপর চাপ বড়তে পারে। তাছাড়া এই অর্থ বিতরণে সুশাসন একটি বড়ো সমস্যা।
সেমিনারে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনার কারণে জীবিকা নির্বাহ এবং পুনরায় কাজে ফিরে যেতে ৩ কোটি ৩০ লাখ দরিদ্র মানুষের জন্য প্রতিমাসে সহায়তা প্রয়োজন ৫ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। আর নতুন দরিদ্রে পরিণত হওয়া ৩ কোটি ৭ লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজন ৫ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে ৭ কোটি দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে সরকারকে কমপক্ষে প্রতি মাসে ১০ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা ব্যয় করা প্রয়োজন। এটি কমপক্ষে তিন মাস অব্যাহত রাখতে হবে।
ইতিমধ্যে অর্থনীতি ও মানুষকে সহায়তায় প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। সেই প্যাকেজ ব্যাংক ঋণ নির্ভর। ব্যাংক নিজেই ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই টাকা কারা গ্রহণ করতে পারবে এখন সেটাই বড়ো প্রশ্ন। কারণ লকডাউনের কারণে উত্পাদন বন্ধ। উত্পাদন কার্যক্রম আগের মতো ফিরে আসেনি। সরবরাহ ব্যবস্থাও ঠিক হয়নি। ব্যাবসায়িক কার্যক্রম এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংকের ঋণনির্ভর হওয়ার ফলে প্রণোদনা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার তার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছেন বলে তিনি মনে করেন। করোনা পরিস্থিতি মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করতে সরকারকে স্বচ্ছতার সঙ্গে কার্যকরী সহায়তা প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply