টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে দূর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। করোনাকালীন সময়ে কলেজ বন্ধ থাকার ফলে হোস্টেল ফাঁকা থাকার সুযোগে কয়েক লাখ টাকার মালামাল চুরি করে নেয় চোরচক্র।
কলেজের অধ্যক্ষের আবাসিক ভবনের ২০-২৫ গজের মধ্যে এমন চুরি সংঘঠিত হলেও চুরির বিষয়ে টেরই পায়নি বলে দাবি করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) বিকেলে চুরির বিষয়ে জানতে পারার ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোন আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রদক্ষেপ নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ। চুরির বিষয়ে জানার পর শুক্রবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে হোস্টেলে ছুটে আসে ছাত্রীরা।
ছাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ১৭ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারনে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ২৮ মার্চ পর্যন্ত এই ছুটি থাকার কথা থাকলেও, করোনা ভাইরাসের কারনে এখন পর্যন্ত ছুটি বহাল রয়েছে। এর আগে গত ১৬ মার্চ ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে নোটিশ প্রদান করা হয়। ২৮ তারিখে কলেজ খোলার কথা থাকায় হোস্টেলের ছাত্রীরা তাদের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই রেখে যায়। কলেজ ক্যাম্পাসে হোস্টেল অবস্থিত হওয়ায়, সেখানে ছাত্রীদের জিনিসপত্রের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বও থাকে কলেজ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারপরও এমন চুরির ঘটনা কিভাবে ঘটে সেই বিষয়ে নির্বিকার কলেজ কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার দুপুরে কলেজের ছাত্রী হোস্টেলে গিয়ে দেখা যায়, হোস্টেলের চারপাশে পুরো এলাকায় গাছপালায় জঙ্গল হয়ে রয়েছে। বিশাল এলাকাজুরে কলেজের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও ডরমেটরি, ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক হোস্টেল অবস্থিত হলেও, প্রতিষ্ঠানটিতে নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে মাত্র দুই জন। কলেজ ক্যাম্পাসে এমন বড় চুরির ঘটনা ঘটলেও সেখানে আসেননি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ। আসেননি কোন শিক্ষক বা কর্মকর্তা। হোস্টেলে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রীদের থাকার জন্য ৭টি কক্ষ ও ডাইনিং রুমে জিনিসপত্রের তছনছ হয়ে আছে। সবগুলো ঘরেই ছাত্রীদের কাপড়, বইপত্র, প্রয়োজনীয় জিনিস পড়ে আছে। হোস্টেলের ওয়াশরুমের কল, বালতিও নিয়ে গেছে চোরচক্র। বাদ যায়নি ছাত্রীদের কাপড় চোপর, নগদ টাকা, দুটি ল্যাপটপ, একটি ডেক্সটপ কম্পিউটার, প্রায় ৩০ টির মতো টেবিল ফ্যান, চার্জার ফ্যান, রুমের লাইট, থালাবাসন, বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক আয়রন, কয়েকটি ইলেকট্রনিক স্টোভ, গ্যাসের চুলা। শুধুতাই নয়, ছাত্রীদের লাগেজ থেকে তাদের একাডেমিক, পূর্ববর্তী শিক্ষার সার্টিফেকেটসহ প্রয়োজনীয় কাজপত্রও নিয়ে গেছে চোরেরা। হোস্টেলের ছাদ থেকে দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিছানার চাদর দিয়ে রশি বানিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গেছে।
কলেজের এ্যাপারেল ডিপার্টমেন্টের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ও হোস্টেলে আবাসিকে থাকা ছাত্রী সুরাইয়া সুলতানা বলেন, ‘গত ১৬ মার্চ কলেজ বন্ধ ও হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ আসার পর শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কয়েকটি কাপড় নিয়ে আমরা সবাই বাড়ি গিয়েছিলাম। ১০ দিন পরই কলেজ খোলা থাকায় আমরা ল্যাপটপ -কম্পিউটার, নগদ টাকাসহ কোন কিছুই নিয়ে যাইনি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে হোস্টেল সুপার ফোন করে চুরির ঘটনা জানায়। পরে আজ সকালে আমরা হোস্টেলে এসে সবকিছু তছনছ দেখতে পাই। এর আগেও এখানে চুরির ঘটনা ঘটেছে। আমরা পরিবার পরিজন ছেড়ে এখানে থাকলেও আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব নাজুক। আগের চুরির বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।’
হোস্টেলের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী দিপা সমাদ্দার বলেন, ‘আমাদের হোস্টেলে ছাত্রীদের খাওয়া খরচ নিজেদের বহন করতে হয়। আমরা ম্যাসের মতো মিল সিস্টেমে খেয়ে থাকি। হোস্টেলের কোন লাইট বা অন্য কিছু নষ্ট হলে ছাত্রীদের নিজ খরচে মেরামত করতে হয়। এই জন্য আমরা সবাই নির্দিষ্ট পরিমান টাকা জমা রাখি। রুমে একটি বাক্সে ছাত্রীদের খাবার ও অন্যান্য কেনাকাটার জন্য নগদ ৪০ হাজার টাকা ছিলো। এছাড়া প্রতিটি ছাত্রীরই কম বেশি ব্যক্তিগত টাকাও ছিলো। বন্ধ হওয়ার কদিন পরই কলেজ খোলা থাকার কথা থাকায় কেউ সেই টাকা নেয়নি। অনেকের স্বর্ণেও গহনাও ছিলো। সেগুলোও চুরি হয়েছে।’
ফেব্রিক ডিপার্টমেন্টের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আম্বিয়া আক্তার আঁখি বলেন, ‘দ্বিতল বিশিষ্ট এই হোস্টেলে ৭টি রুমে ২৭ জন ছাত্রী থাকতাম। হোস্টেলে প্রচুর গরম থাকায় প্রত্যেক ছাত্রীরই আলাদা টেবিল ফ্যান-চার্জার ফ্যান ছিলো। সেগুলো সবই চুরি হয়েছে। আমাদের সার্টিফিকেটও চুরি হয়েছে। এর আগেও এখানে চুরি হয়েছে। তখন আমাদের কলেজ প্রশাসনকে জানানোর পর তারা আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিশ্রæতি দিলেও আজও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমি বলেন, ‘এখানে নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত সহ সকল শ্রেণির শিক্ষার্থী রয়েছে। এই সকল ছাত্রীদের বলতে গেলে একাডেমিক সকল কাগজপত্রই চুরি হয়েছে। এতে আমাদের ভবিষ্যতও অনেকটাই অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিটি ছাত্রীরই কমবেশি অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
হোস্টেলের নাইটগার্ডের দায়িত্বে থাকা জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, ‘গত ২ মাস ধরে কলেজের নিজস্ব সাবস্টেশন নষ্ট থাকায় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ বিহীন রয়েছে। যেহেতু ছাত্রী হোস্টেল আর ছাত্রীরাও নেই, তাই আমরা শুধুমাত্র বাহিরে থেকে টর্চ দিয়েই দেখাশোনা করতাম। আর এই হোস্টেলটিও মূল ক্যাম্পাসের বাহিরে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রোডের পাশে। এতে নিরাপত্তাকর্মী কম থাকায় নজরদারি করাও সম্ভব হয় না। বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয়রা হোস্টেলের পিছনের সীমানা দেয়াল টপকে এক যুবককে কিছু মালামাল নিতে দেখে। পরে আমি হোস্টেল সুপারকে সেটি জানাই। পরে তিনি এসে দেখেন হোস্টেলের মূল ফটকের সামনের তালা ভাঙ্গা। পরে ভিতরে গিয়ে প্রতিটি রুমের তালা ভাঙ্গাসহ সবকিছু তছনছ দেখা যায়।
হোস্টেল সুপার তোহফা আক্তার বলেন, আমি মূলত কলেজের ফোরম্যানের দায়িত্বে রয়েছি। পাশাপাশি ছাত্রী হোস্টেলের সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছি। চুরির বিষয়টি জানার পরই উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করেছ, অধ্যক্ষ কলেজের বাহিরে থাকায় কোন ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. বকতিয়ার হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে অসুস্থতার অযুহাতে কথা বলতে এড়িয়ে যান। এসময় তিনি না আসা পর্যন্ত হোস্টেলে প্রবেশ করা যাবে না বলেও সাংবাদিকদের বলেন। পরে একপর্যায়ে তিনি ভিতরে প্রবেশের জন্য সাংবাদিকদের অনুমতি দেন। এসময় তার কাছে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম খোলা থাকা ও এমন ঘটনার ২৪ ঘন্টা পেড়িয়ে গেলেও কোন ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট থানায় এই বিষয়ে কথা হয়েছে। শনিবার আমি কলেজে যাওয়ার পর ছাত্রীদের সাথে কথা বলে তাদের কি কি ক্ষতি হয়েছে সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। গত ৭দিন আগেও হোস্টেল সুপার হোস্টেলের ভিতরে প্রবেশ করে সবকিছু ঠিকঠাক দেখেছি। এই ৭দিনের মধ্যেই সম্ভবত কোন এক সময় এমন চুরি ঘটনা ঘটেছে।’
কলেজের ভিতরে ছাত্র হোস্টেল আর বাহিড়ে ছাত্রী হোস্টেল কেন সেই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েকমাস আগে এখানে যোগ দিয়েছি। আসার পরই করোনা শুরু হয়েছে। তাই এই বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। তবে আমি যোগ দেয়ার পর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছি। যেহেতু আমাদের নিরাপত্তকর্মীও মাত্র দুইজন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দেয়।’
প্রতিষ্ঠানে তার অবর্তমানে কে দায়িত্ব পালন করেন এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি হয়তো সেখানে নেই, কিন্তু হোস্টেল সুপার তোহফা আক্তার বিষয়টি দেখছেন। আমি না থাকলে তিনিই অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।’ এসময় একজন ফোরম্যান হয়ে তোহফা আক্তার কিভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এই বিষয়ে কালিহাতী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাসান আল মামুনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার কলেজ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে জানানোর পরই সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ কোন লিখিত অভিযোগ বা মামলা দায়ের করেননি। তারা অভিযোগ দিলে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply