এম শহিদুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ ঢাকা নটরডেম কলেজে লেখা পড়া শেখা মফিজুল খান ও তার ছেলে জুয়েল খানের পরিবারকে খ্রীষ্টান আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সমাজচ্যূত বা একঘরে করে রাখার অভিযোগের কোন প্রমান মিলেনি সরেজমিন তদন্তকালে। বরং এমন রিউমার তুলে এলাকার মানুষ তথা প্রশাসনে স্যাম্পেথী অর্জন করে গর্ভধারিনী মা ও প্রতিবন্ধি বোনের ভরন-পোষণ না করে বৃদ্ধ অসহায় বিধবা মায়ের নামের জমি নিজেদের করে নেবার ফন্দি এটেছেন ওই অকৃতজ্ঞ ছেলেরা।
জানা যায়, মৃত্যুর আগে তছিরন বেগমের নামে তার স্বামী আলেপ খান ৮০ শতাংশ জমি লিখে দিয়ে যান। ওই সময় দুই ছেলে এবং আরও এক সৎ ছেলের নামেও জমি লিখে দেন তিনি। প্রায় ১২ বছর আগে তছিরন বেগমের স্বামী আলেপ খান মারা গেছেন। এরপর থেকে মা তছিরন বেগমের জমির ওপরেই চোখ তার দুই ছেলের। তারা সেবার বদলে শুধু জমি চায়। ৮৮ বছর বয়সী বৃদ্ধা মায়ের ভরণপোষণও বাদ দিয়েছে দুই ‘গুণধর’ ছেলে। এছাড়াও বৃদ্ধা মায়ের ঘর থেকে বিদ্যুৎ লাইনও কেটে দিয়েছে মফিজুল খান নামের তার এক ছেলে। এমন অভিযোগ করেছেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের তফরপুর পাথালিয়া গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধা তছিরন বেগম।
মফিজুল খান ও তার ছেলে নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী জুয়েল খানের দাবি- ‘জমি সংক্রান্ত সালিশে জুয়েলকে মারধর করা হয়। এছাড়াও শরিফুল ও মাসুদ নামের দুই ব্যক্তি জুয়েলকে খ্রিস্টান ও নাস্তিক উপাধি দিয়ে প্রায় চার মাস ধরে সমাজচ্যুত করে রেখেছে।’ এ ঘটনায় জুয়েল বাদী হয়ে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে বৃদ্ধা তছিরন বেগম বাদী হয়ে গত ৩ মে ৫ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন। সম্প্রতি ধর্মীয় বিষয়টিকে সামনে এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল মালেক ও মির্জাপুর থানার ওসি সায়েদুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ‘বৃদ্ধা তছিরন বেগম ও মফিজুল খানের ঘর পাশাপাশি হলেও উঠানের মাঝখানে বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। বৃদ্ধা মা তার প্রতিবন্ধী এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন। ছেলে মফিজুলের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও বৃদ্ধা মায়ের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। বৃদ্ধা তছিরন বেগম সাংবাদিক দেখে এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘বাবা আমাগো সমাধান করে দাও। এই বয়সে এসে আজ ছেলেদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।’
স্থানীয়রা জানান, তছিরন বেগমের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। এছাড়াও সৎ ছেলে রয়েছে আরও একজন। তিন ছেলে বিয়ে করে পৃথকভাবে সংসার করছে। এদের মধ্যে সৎ ছেলে আব্দুর রশিদের মৃত্যু হয়েছে। চার মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী। শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে নাজমাকে নিয়ে তিনি আলাদাভাবে বসবাস করছেন।
মৃত্যুর আগে তছিরন বেগমের নামে তার স্বামী আলেপ খান ৮০ শতাংশ জমি লিখে দিয়ে যান। ওই সময় তিন ছেলের নামেও জমি দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রতিবন্ধী নাজমা বেগমের নামেও ৬ শতাংশ জমি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তছিরন বেগম তার তিন মেয়ের নামে ৮০ শতাংশ থেকে ৩৬ শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন। আর বাকি জমি তছিরনের দুই ছেলে মফিজুল ও রফিকুল তার কাছ থেকে জোর করে লিখে নেওয়ার জন্য পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
গত রমজানে মফিজুল খান ও তার ছেলে জুয়েল মিলে নাজমা এবং মৃত আব্দুর রশিদের জমিতে টয়লেট নির্মাণের জন্য যায়। বিষয়টি নিয়ে ওই সময় আব্দুর রশিদের ছেলে শরিফুল ও নাজমার সঙ্গে জুয়েলের পরিবারের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর চলতি বছরের ১ মে বিষয়টি নিয়ে সালিশি বৈঠকে বসা হয়। সালিশি বৈঠকে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর দুই পক্ষই পৃথকভাবে মামলা দায়ের করে।
মফিজুল খান বলেন, ‘ভাতিজার সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ। মাকে হাত করে সামনে রেখে তারা বিরোধ করছে। এই ৮০ বছর বয়সে এসে মা বলে বাদ দেয় না। এ পর্যন্ত কার ভাত খেয়েছেন তিনি। ভাতিজা শরিফুল চাইছে যাতে আমার দুই ছেলেকে শিক্ষিত করতে না পারি। আর বাইরে যাতে না পাঠাতে পারি। এটাই তারা চাচ্ছে। ছেলে জুয়েলকে মারার জন্যও হুমকি দিচ্ছে ভাতিজা শরিফুল।’
নটর ডেম কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও মফিজুল খানের ছেলে জুয়েল খান বলেন, ‘মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম ও স্থানীয় মসজিদের খণ্ডকালীন মোয়াজ্জিন মাসুদ আমাকে সালিশে মারধর করেছে। তারা আমাকে বলে- তুই নটর ডেম কলেজে পড়েছিস। তুই খ্রিস্টান ও নাস্তিক। গত ১ মে থেকে আমাদের পরিবারকে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে তারা বের হতে দিচ্ছে না। কোরবানির ঈদেও সমাজে গরু জবাই করতে দেয়নি।’
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওই বৃদ্ধার নাতি শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দাদিকে কেন্দ্র করে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দাদিকে তারা ভরণপোষণ করে না। তার জমি জবরদখল করে খাচ্ছে।জোর করে দাদী ও ফুফুর জমি লিখে নেবার নানা কৌশল অবলম্বন করে চলছে ওরা। জমি লিখে না দেয়ায় বৃদ্ধা দাদী ও প্রতিবন্ধী ফুফুকে অমানবিক অত্যাচার করে তারা। বিষয়টি নিয়ে এলাকার মাতব্বররা সালিশে বসেছিলেন। সেখানে আমাকেও ডাকা হয়েছিল। ওই সময় ভিডিও করা নিয়ে জুয়েলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। পরে জুয়েলরা বিষয়টি নিয়ে মামলা করে। এরপর দাদিও পাল্টা মামলা করে। জুয়েলকে কেউ খ্রিস্টান বা নাস্তিক বলেনি। তাদের সমাজচ্যুতও করা হয়নি। বরং জুয়েলের বাবা বলছে- মা (তছিরন) সমাজে থাকলে সে থাকবে না।’
বৃদ্ধা তছিরন বেগম বলেন, ‘ভরণপোষণের কথা বলে আমার স্বামীর কাছ থেকে তারা জমি লিখে নিয়েছে। এখন তারা আমাকে ভরণপোষণ করছে না। আমার জমির ফসল আমাকেই খাইতে দিচ্ছে না। একটা গাছ ও একটা বাঁশও বেচতে দেয় না । ওরা খুব শাস্তি দিতাছে। আমার ভাইয়ের বাড়ি থেকে টাকা আনছিলাম। তারা সেগুলোও নিয়ে গেছে। এখন আমি আমার জমি বিক্রি করতে চাচ্ছি। এজন্য তারা ঝগড়া শুরু করছে।’
ওই সালিশি বৈঠকের সভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল বাছেদ বলেন, ‘মা-ছেলের মধ্যে ৮০ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধ চলছে। পরে এ ঘটনায় সালিশ বসা হয়। ওই সালিশে জুয়েল মোবাইল দিয়ে ভিডিও করে। তখন পাশে থেকে একজন ছেলে তাকে ধরে। পরে জুয়েলের কাছ থেকে মোবাইল নেওয়া হয়। ওই সময় দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষই জুয়েল ও শরিফুল আমার ভাতিজা। পরে তাদের দুই পক্ষকে বাড়িতে দিয়ে আমি চলে আসি। এ ঘটনায় তারা থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাস্তিক শব্দটা কেউ ব্যবহার করেনি। নাস্তিক বলে কেউ তাকে আখ্যায়িত করেনি। এটা ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। তাদের কেউ সমাজচ্যুত করেনি। তারা সাধারণভাবেই বাজারঘাট করছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য ওয়াহিদুর রহমান ফেরদৌস বলেন, ‘মফিজুল ও রফিকুল তার বৃদ্ধা মাকে দীর্ঘদিন ধরে ভরণপোষণ করে না। বৃদ্ধা তছিরন তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন। তছিরনের স্বামী তার নামে ৮০ শতাংশ জমি লিখে দিয়ে যায়। এখন জমি নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছে।’
তিনিও বলেন, ‘মফিজুলের ছেলে জুয়েলকে কেউ খ্রিস্টান ও নাস্তিক বলেনি। তাদের কেউ সমাজচ্যুতও করেনি।’ এটা নটরডেম পড়া ছেলেটির নষ্ট ব্যবহার। মনগড়া, বানানো কথা। বিষয়টি মীমাংসার জন্য খুব দ্রুতই বসা হবে বলেও তিনি জানান।
মির্জাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সায়েদুর রহমান বলেন, ‘জমি নিয়ে সমস্যা। বিষয়টি সামাজিক পর্যায়ে গিয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। ধর্ম নিয়ে যে কথাবার্তা হয়েছে তা কে বলছে সেটার সঠিক কোনও প্রমাণ আমরা পাইনি। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা জমি সংক্রান্ত বিরোধ, জমি সংক্রান্তই থাক। অন্যদিকে যে টানাটানি চলছে, সেটা যেন না হয়।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল মালেক বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরে এলাকাটি পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে গিয়ে দেখি এটি তাদের পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিষয়টিকে সামনে আনা হয়েছে। কোনও পক্ষ হয়তো সুবিধা গ্রহণের জন্য এটি করে থাকতে পারে। আমরা উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষই আদালতে মামলা দায়ের করেছে। আইনানুযায়ী আদালত থেকে বিষয়টি সুরাহা হবে। তার আগ পর্যন্ত কেউ যেন ধর্মীয় বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা প্রশাসন থেকে তৎপর রয়েছি।’
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply