আনোয়ার হোসেন।
বেনাপোল রেলপথে বাণিজ্য শুরু হওয়ায় খুশি ব্যবসায়ী মহল বেনাপোল বন্দর রেলে পণ্য পরিবহন হওয়ায় ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ কমেছে, সময় বেঁচেছে, বেড়েছে সীমান্ত বাণিজ্যের গতি, এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে বেনাপোলে।
ভারতের বনগাঁর কালিতলা পার্কিং-এ হয়রানির’ হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ঝুঁকেছেন বেনাপোল বন্দর রেলপথে পণ্য আমদানিতে দাবি ব্যবহার কারীদের।
রেল ও ট্রাকে পণ্য পরিবহনের সময় ও ভাড়ার পার্থক্য সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুক্তা টেড্রিং কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল মুননাফ বলেন, একটি ট্রাক ৩৫ থেকে ৪০ মেট্রিকটন ফেব্রিক্স বোঝাই করে আমেদাবাদ ভারত এর বনগাঁ পার্কিং পর্যন্ত পৌছাতে সময় লাগে ৭/৮ দিন, এরপর পার্কিং থেকে বাংলাদেশ গেইট পাশ করে প্রবেশ করতে লাগে আরো ৭/৮ দিন।ট্রান্সপোর্ট ভাড়া ১ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ রুপি।ডিটেন্শন প্রতি দিন ৩৫০০ রুপি।
করোনার আগে বেনাপোলে কেবল কার্গো রেলের’ মাধ্যমে ভারত থেকে সপ্তাহে একটি বা দুটি রেল আসত। আবার কখনো দেখা গেছে মাসে একটি রেলও আসেনি। কিন্তু বর্তমানে চিত্র ভিন্ন। প্রতিদিন ‘কার্গোরেল, সাইডোর কার্গোরেল এবং প্যার্সেল ভ্যানের’ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ট্রাকে আসত, এখন তা রেলে আসছে। এর ফলে কমেছে ট্রাক চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, ব্যবসায়ীরা কম সময় ও অল্প খরচে পন্য আনতে পারছেন। ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ায় এপথে আমদানি বাড়ছে।
অথচ রেলে একই পণ্য বোঝাই করার পর রেল কোথাও দাড়িয়ে থাকে না। আমেদাবাদ ভারত থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল পর্যন্ত দুরত্ব ২৪০০ কিলোমিটার, পৌছাতে সময় লাগে ৩/৫ দিন। ভাড়া প্রতি মেট্রিকটনের জন্য প্রথম এক’শ কিলোমিটার ৩৫৪ রুপি। এরপর প্রতি এক’শ কিলোমিটারে ৫ শতাংশ হারে কমতে থাকবে। রেলের ডিটেন্শন ঘন্টা প্রতি ও ওয়াগন প্রতি ৩০০ থেকে ৮০০ রুপি পর্যন্ত।
বেনাপোলের অপর আর একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এমএম ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটার মেহেরউল্লাহ বলেন, রেলে পণ্য আমদানিতে সময় কম লাগে, তুলনামুলক খরচ কম এবং পণ্যের যথেষ্ট নিরাপত্তা রয়েছে।
ভারতের রানাঘাট থেকে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর বেনাপোল বন্দরে সেই পণ্যচালান পৌছাতে সময় লাগে মাত্র ৩ ঘন্টা থেকে ১দিন। কিন্তু সড়ক পথে বনগাঁ থেকে বেনাপোল একটি ট্রাক পৌছাতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৮ দিন। প্রতিদিন ডিটেনশন দিতে হয় ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা।”
মেহেরুল্লাহ বলেন, কলকাতা থেকে ২০ মেট্রিকটন চাউল আনতে ট্রাক ভাড়া লাগে ৪০ হাজার রুপি, ওই একই পরিমান চাউল রেল ওয়াগনে আনলে ভাড়া লাগে ৩০ হাজার রুপি। রেলে পণ্যচালান আনতে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ দিন, সেখানে ট্রাকে আনতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৮ দিন। প্রতিদিন ট্রাকের ডিটেনশন দিতে হয় ২৫০০ থেকে ৪০০০ রুপি। এখানে অন্তত আরো ২০হাজার রুপি অতিরিক্ত লাগবে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভা কর্তৃপক্ষের খাম-খেয়ালিপনা, আমদানি-রপ্তানিতে নাক গলানো, পৌরসভার কালিতলা পার্কিং সৃষ্টি করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলো জোরপূর্বক পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস কর্পোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে চাঁদার জন্য কালিতলা পার্কিংয়ে রেখে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই তারা সড়ক পথে ট্রাক বাদ দিয়ে এখন রেলে পন্য আমদানির দিকে ঝুঁকছেন।
ভারত এর বনগা্ঁ থেকে প্রতিদিন নিজেদের ইচ্ছে মতো কবে কোন ট্রাক কোন দিন বেনাপোলে যাবে তা তারাই নির্ধারণ করে দেওয়ালে কাগজ সেটে দিতো। দীর্ঘ দিন অপেক্ষার কারণে আমদানিকৃত পণ্যগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তারপরও শিল্পের কাঁচামাল সময় মতো কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় শিল্প কার্যক্রম ব্যাহত হতো মারাত্মক ভাবে।
বাংলাদেশি বন্দর ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করে বলেন, ভারতের বনগাঁ পৌরসভার অধিনে কালিতলায় আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক দিনের পর দিন পার্কিং এ রেখে একটি সিন্ডিকেট নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ওই পার্কিং থেকে কন্ট্রাকের মাধ্যমে ৩০/৪০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া নিয়ে বেনাপোল বন্দরে ট্রাক পাঠায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে বাংলাদেশি আমদানিকারক ও ভারতের রপ্তানিকারকরা হিমসিম খাচ্ছিল। এর ফলে প্রতিটি পণ্য চালানে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ায় যার প্রভাব এসে পড়ছে বাংলাদেশের বাজারে। তারপরও দু’দিন পর পর নানা অজুহাতে ধর্মঘটের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দু‘দেশের ব্যবসায়ীরা।
ভারত থেকে রেল ওয়াগন, কন্টিনার, কার্গো ও রেল টানেলের মাধ্যমে পণ্য আনা হচ্ছে। রেলবিভাগের ওয়াগনে আনা পণ্য চালানে খরচ কম হয় তবে কন্টিনার কিম্বা টানেলের মাধ্যমে পণ্য আনতে খরচ একটু বেশি। যেহেতু কন্টিনার আলাদা ভাড়া করতে হয় বলেন মেহেরুল্লাহ।
রেলে পণ্য আমদানি বাড়ার কারন সম্পর্কে বেনাপোল সিএন্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, ট্রাকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতীয় সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের আইন বিষয়ক সম্পাদক মশিয়ার রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পেক্ষিতে করোনাকালিন সময়ে দু‘দেশের কাস্টমস, রেল মন্ত্রণালয় ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারকরা ২০২০ সালের ৪ জুন রেল পথে সব ধরণের পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়।
কমিশনার আজিজুর রহমান বলেন, রেল কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি বাণিজ্য শুরুতে আমাদের স্টকহোল্ডারসহ সব ব্যবসায়ীরা খুশি। এতে সময় ও খরচ যেমন বাঁচবে তেমনি পণ্যের যথেষ্ট নিরাপত্তাও রয়েছে। ভারত থেকে রেল যোগে মালামাল আসাতে রেল খাতেও উন্নয়ন হবে। বন্দর একটি চার্জ পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের খরচখরচাও কম হবে।এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলো
বেনাপোল শুল্ক ভবনের কমিশনার মোঃ আজিজুর রহমান বলেন, রেল কন্টেইনারের মাধ্যমে আমদানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। রেলপথে আসা পণ্য থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৬১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল মাত্র ৮ কোটি ৮৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছরে এটি বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক মামুন কবীর তরফদার বলেন, রেলের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়ায় পণ্য আমদানি সহজ হয়েছে। এসব পণ্যচালান আগে ট্রাকে আসত।এখন রেলপথে পণ্য আমদানি হওয়ায় বেনাপোলে ট্রাক জট কমায় যানজটও কমেছে তবে বেড়েছে আমদানি। সরকারও বেশি রাজস্ব পাচ্ছে।
বেনাপোল রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার শাহিদুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ভারত থেকে স্থলপথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রেলপথে পণ্য আমদানি হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দর রেলপথে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৩ মেট্রিক টন। অথচ গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ পথে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ দশমিক ৯ মেট্রিকটন।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply