দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে পাঁচ ঘণ্টা ১৮ মিনিট বৈঠক করলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭মে বিকাল সাড়ে ৫টায় গণভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির সূচনা বক্তব্যের পর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে দলটির নেতা এবং দলীয় এমপিদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইভিএম পদ্ধতিতে। এ নির্বাচনে আমরা সব দলের অংশগ্রহণ চাই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে যাকেই নৌকা দেওয়া হবে তাকে নিজগুণে জিতে আসতে হবে। কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনী আসন ধরে জরিপ চলছে। জরিপের আলোকে প্রার্থী বাছাই করা হবে।
যাকে দিয়ে বিজয়ী হওয়া সম্ভব তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, চলতি বছরে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে, সেখানে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী ছিল। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছে। এ ভোট নিয়ে কোনো অভিযোগ কেউ করতে পারেনি।
কাজেই আমি দেখতে চাই, দেশের মানুষের জন্য এত করলাম, দেশের মানুষ আমাকে কী দেয়? ইভিএমে ভোটে যাতে কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকে। এজন্য দলীয় নেতা-কর্মী এবং এমপিদের এলাকায় যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কর্মীবান্ধব হতে হবে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৈঠকসূত্র জানান, দীর্ঘদিন পর গতকাল সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কার্যনির্বাহী বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে সভাপতি হিসেবে সূচনা বক্তব্য দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। এরপর দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। এরপর সূচনা বক্তব্য দেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি তৃণমূলে সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে ত্যাগী-পরীক্ষিতদের বাদ দেওয়া, হাইব্রিড, নব্য লীগার ও টাকার কুমিরদের দলে পদ দেওয়া হচ্ছে মর্মে দলীয় সভানেত্রীকে অবহিত করেন। দীর্ঘ ২৫ মিনিট বক্তৃতা করেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এরপর বক্তব্য দেন দলটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে। বিগত নির্বাচন নিয়ে অনেক কথাবার্তা শুনতে হয়। আগামী নির্বাচনে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে কীভাবে আনা যায় সে ব্যাপারে দলীয় প্রধানের দিকনির্দেশনা চান তিনি। একই সঙ্গে দল বেশি আমলানির্ভর হয়ে পড়ছে বলেও মত তুলে ধরেন। বেশি আমলানির্ভরতা আওয়ামী লীগের ক্ষতি হচ্ছে বলেও বৈঠকে তুলে ধরেন শাজাহান খান। তিনি বলেন, আমলারা এখন এত বেশি প্রভাবশালী হয়ে পড়েছে যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কোনো গুরুত্ব দেয় না। অথচ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আমলাদের প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমন কিছু না বললেও বলেন, সবাই মিলেই কাজ হচ্ছে। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে।
বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা প্রসঙ্গে শাজাহান খানের প্রস্তাব প্রসঙ্গে কথা বলেন দলটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের কেন আমরা নির্বাচনে আনব? তারাই নির্বাচনে আসতে চায় না। হানিফের কথার জবাব দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। হানিফকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, তুমি তো ১০ জন নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে হারিয়েছ ‘মাইম্যান’ বিজয়ী করতে গিয়ে। তুমি চাইবা বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ভয় পায় তারাই চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া যায়। আমি চাই সবার অংশগ্রহণ। ত্যাগী লোকদের জায়গা দিতে হবে। ত্যাগীরা দুঃসময়ে ঝুঁকি নেয়। মাইম্যানরা সব সময় সাইড লাইনে থাকে। সময়মতো পাওয়া যায় না। সভায় বক্তব্য দেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ মোট ১৮ জন নেতানেত্রী। ছয় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তাদের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন। দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক দেশের বাইরে রয়েছেন।
বিদ্রোহীদের ক্ষমা করার সুযোগ নেই : ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যারাই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের আওয়ামী লীগ ক্ষমা করবে না। যারা এখনো পদে আছেন, বহিষ্কার হননি তাদের সরিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হবে। গতকাল বৈঠকে শেখ হাসিনা এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রসঙ্গে কথা তোলা হলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, দল করতে হলে সিদ্ধান্ত মানতে হবে। সিদ্ধান্ত না মানলে দল করার প্রয়োজন নেই। যারাই নৌকার বিরোধিতা করেছে তাদের দলীয় সব পদপদবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যেখানে এখনো সম্মেলন হয়নি কিন্তু বিদ্রোহী ব্যক্তি দলীয় পদে আসীন আছে তাকে বাদ দিয়ে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করে সম্মেলন করতে হবে। কোনোভাবেই বিদ্রোহীদের মাফ করার সুযোগ নেই।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে জমকালো : পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যথাসময়ে হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই পদ্মা সেতু তৈরি করেছি। দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সেতুর উদ্বোধন করব।
দ্রুত সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের তাগিদ : জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন দ্রুত এগিয়ে চলছে। জেলা-উপজেলার সঙ্গে দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম মেয়াদোত্তীর্ণ সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির তাগিদ দিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করলেই শেষ হবে না। সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলনও শেষ করতে হবে। অনেক সংগঠনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্মেলনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের তাগাদা দেন তিনি।
২৩ জুন সারা দেশে বর্ণাঢ্য আয়োজন : ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সারা দেশে ওই দিন ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হবে। এজন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বৈঠকে নীলফামারীর ডোমার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদকে ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিতসভায় দেওয়া অব্যাহতি বহাল রাখা হয়েছে। নতুন করে তাকে শোকজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শোকজের জবাব পাওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়া নেত্রীর নির্দেশ : বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে দলকে এখন থেকেই সুসংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলের ব্যাপারে নেত্রী বলেছেন তারা মিছিল-মিটিং সমাবেশ করুক। তারা স্বাধীনভাবে করুক। আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আজকের বৈঠকে মূলত পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন, পরবর্তী জাতীয় সম্মেলন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী জাতীয় সম্মেলন এবং জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে সারা বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ প্রোগ্রাম জোরদার করতে হবে। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply