নির্দিষ্ট কোন ধর্মীয় দর্শনে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তিনি একদিকে কালি দেবীর বন্দনাবাক্যে শ্যামা সংগীত লিখেছেন, অন্যদিকে আল্লাহ আর রাসুলের গুণকীর্তন করে লিখেছেন গজল, হামদ-নাত।
পৃথিবীতে নজরুলই বোধহয় একমাত্র লেখক মন্দিরে পুরোহিত ভজন কীর্তনে যাঁর লিখা গানে গেয়ে উঠেন, “কালি কালি মন্ত্র জপি বসে লোকের ঘোর শ্মশানে- মা অভয়ার নামের গুণে শান্তি যদি পাই এ প্ৰাণে!”
আবার মসজিদের মিম্বরে বসে মোল্লা মৌলভীরা গেয়ে ওঠেন, “আল্লাহকে যে পাইতে চায়- হযরতকে ভালবেসে- আরশ কুর্সী লওহ কালাম- না চাইতেই পেয়েছে সে। রসুল নামের রশি ধরে, যেতে হবে খোদার ঘরে- নদী-তরঙ্গে যে পড়েছে ভাই- দরিয়াতে সে আপনি মেশে।”
ধর্মের মুল ভিত্তি হলো- কেউ যখন কোনো একটি ধর্মে বিশ্বাস করবে, সাথে সাথে অন্য সমস্ত ধর্মকে অবিশ্বাস করতে হবে। অথবা আরেকটু পরিস্কার করে বললে, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মে অবিশ্বাস স্থাপন করে কেবল একটি ধর্মে বিশ্বাসের নামই ধর্ম। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই যে ধর্ম অন্য কোনো ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়।
তাহলে এই যে নজরুল কখনো আল্লাহর, কখনো কালী দেবীর বন্দনায় অনবরত লিখে গেছেন তাকে কী বলা যায়? হিন্দু, মুসলিম, সংশয়বাদী? কিন্তু তাঁর এমন লেখাও আছে, যা পড়লে তাঁকে উপরিউক্ত তিন শ্রেণির কোনোটাতে না ফেলে বরং অবিশ্বাসী বা নাস্তিক বললেই সবচেয়ে যথার্থ বলা হয়।
আসমানী কিতাব বলে যারা কোরআনকে পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবেন, কবি তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”
কবি সবধর্মের উপাসনালয় ভেঙে দেয়ারও পক্ষে ছিলেন! “ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা, ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ, ভাঙিয়া গির্জা গাহি সংগীত। এক মানবের একই রক্ত মেশা, কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”
মানুষ হিসেবে আমি যখন অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলি, আমাকে ওরা নাস্তিক বলে গালাগাল দেয়। অথচ আমি শ্যামা সংগীতও লিখিনি, মসজিদ ভাঙার কথাও বলিনি। নজরুল কালীপূজার জন্য শ্যামা সংগীত লিখেছেন, মসজিদ ভাঙার জন্য হাতুড়ি-শাবল নিয়ে তেড়েফুঁড়ে যেতে আহ্বান করে গেছেন, আমৃত্যু ভিন্নধর্মাবলম্বী নারীর সাথে সংসার করেছেন, ‘কৃষ্ণ’ আর ‘মুহাম্মদ’র নাম যুক্ত করে সন্তানের নাম রেখেছেন! অথচ ওরা নজরুলের নাম দিয়েছে ‘ইসলামিক কবি!’ ওয়াজ-মাহফিলের আগে মোল্লা আর তার গোল্লায় যাওয়া বাহিনী ঢুলুঢুলু করে নজরুল লেখা নাত গায়, ‘তুমি যে নুরেরও নবী, নিখিলে ধ্যানেরও ছবি।’ আর শুধু মানুষকে হিন্দু-মুসলমান ভাবার আগে ‘মানুষ’ ভাবার কথা বলি বলেই আমাকে নাস্তিক বলে তেড়েফুঁড়ে আসে। এদের বিবেচনা দেখলে রাগের চেয়ে করুনা বেশি হয়।
ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকলে নজরুল এমন ভক্তিমূলক শ্যামা সংগীত লিখতে পারতেন না। সুতরাং নজরুলের গজল শুনে যারা তাকে ইসলামিক কবি বলছেন, তারা তাঁর একটি শ্যামা সংগীত শুনুন। ভক্তি না থাকলে এমন দরদ ঢেলে লেখা যায় না। নজরুলের শ্যামা সংগীত ছাড়া কালীপূজাই সম্পন্ন হয় না।
নজরুল মুসলমান ছিলেন না, হিন্দুও না। নজরুল ছিলেন ‘মানুষ’। মানুষ ছিলেন বলেই তিনি মানুষের কথা বলে গেছেন অকপটে। মানুষের আচারিক ধর্মের কথা বলে গেছেন। সব ধর্ম এবং সব ধর্মের মানুষের জন্য তাঁর বলা কথাগুলোই প্রমাণ করে, তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের ছিলেন না। ছিলেন না নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের।
রহমান বর্ণিল,
ফেসবুক থেকে।
All Rights Reserved: Duronto Sotter Sondhane (Dusos)
Leave a Reply